শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াই অ্যাসাইনমেন্ট-পরীক্ষা, অযৌক্তিক বলছেন শিক্ষার্থীরা
- আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৯:৩৯ AM , আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২১, ১০:৪০ AM
দেশে করোনার সংক্রমণ না কমায় বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। তবে যথাসময়ে পরীক্ষা নিতে না পারলেও এবার অটো পাসের পক্ষে নয় সরকার।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে চলতি বছর নভেম্বরে হতে পারে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করতে সরকার ইতিমধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করেছে এবং সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে চলছে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও বলছে, নভেম্বরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তুতিতেই পরীক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। তবে কোনোরকম ক্লাস কিংবা একাডেমিক পরীক্ষা ছাড়াই শুধুমাত্র অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তুতির উপর ভিত্তি করে নভেম্বরে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পরীক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার এই কঠিন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মূল্যায়ন কিভাবে হবে সে ব্যপারে শিক্ষার্থীদের মতামত জরিপ করা দরকার। এসব সরকারের একার সিদ্ধান্ত না।
তাদের মতে, অ্যাসাইনমেন্ট কখনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প হত পারে না। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করিয়ে যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি পূরণ করে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী আসিফ মোহাম্মাদ হক বলেন, শুধু অ্যাসাইমেন্টের মাধ্যমে কিভাবে জ্ঞান অর্জন করে এসএসসি পরীক্ষায় বসবো তা নিয়ে আছে বিরাট দুশ্চিন্তা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই দেখে দেখে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট লিখছে। এসব অ্যাসাইনমেন্ট পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অ্যাসাইনমেন্ট কখনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিকল্প হতে পারে না। তাই অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে সরকারের পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে করছি।
সায়াদ নামে আরেক এসএসসি পরীক্ষার্থী বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে পড়াশোনায় অবশ্যই আমরা পিছিয়ে পড়েছি। এই সময়গুলোতে অনলাইন ক্লাস হলেও সেগুলো তেমন কার্যকরী ছিল না। মূলত অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট এগুলো পড়ালেখার ক্ষেত্রে তেমন সাহায্যকারী না। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের কথা বলা হলেও একটা নিয়মের অধীনে না থাকার ফলে বেসিক পড়াশোনা গুলো অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে পরীক্ষা নেওয়ার কথা শুনে অনেকটা ভীতি কাজ করছে। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করিয়ে যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি পূরণ করে সরকারের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুল পড়ুয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী কাশফিয়া জামান অপলা (ছদ্মনাম) বলেন, এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বর্তমানে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম থাকলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে মনে হয় না৷ কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসব অ্যাসাইনমেন্ট শুধু করার জন্যই করছে। গুরুত্বের সাথে করছে না।
“১২ সপ্তাহের অ্যাসাইনমেন্টের পাশাপাশি নভেম্বরে পরিস্থিতি অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া কথা বলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শুধু অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তুতির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”
চট্টগ্রামের মিরসরাই মারুফ মডেল হাই স্কুল পড়ুয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী কাজী আজিজুর রহমান বলেন, সরকারের নড়বড়ে সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। শ্রেণিকক্ষে সরাসরি ক্লাস-পরীক্ষার ফলে পড়াশোনার যে গতি থাকে তা এখন নেই বললেই চলে। দফায় দফায় পরীক্ষার তারিখ পেছানোর ফলে পরীক্ষা হবে কি হবে না তা নিয়ে শঙ্কা কাটছেনা৷ সংকট কাটিয়ে উঠতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস দেওয়া হয়েছে এবং সংক্ষিপ্ত সিলাবাসের উপর বর্তমানে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। যা পুরোটাই মূল্যহীন।
“সবাই দেখে দেখে লিখছে, একদম হুবহু বইয়ের উত্তর লিখতে গিয়ে অনেকে আবার ঠিকমতো লেখা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও দু্শ্চিন্তা করছে। এছাড়া এসব অ্যাসাইনমেন্ট করতে প্রয়োজন হচ্ছে A4 সাইজের পেপার। যা হয়তো অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের কেনার সামর্থ্যও নাই।এসব অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে মূল্যায়ন কিংবা অ্যাসাইনমেন্টকে পরীক্ষার প্রস্তুতি বিবেচনায় এনে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা দেখছিনা৷ প্রয়োজন সরাসরি ক্লাস ও পরীক্ষা এবং এর ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা দিতে চাই আমরা৷”
ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসা পড়ুয়া দাখিল পরীক্ষার্থী সাইদুল ইসলাম সাকিব বলেন, এখন অ্যাসাইনমেন্ট লিখে আবার করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ব্যতিত শুধু অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তুতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। অ্যাসাইনমেন্ট লেখার মাধ্যমে কখনো পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। তাহলে এখন অ্যাসাইনমেন্ট করবো নাকি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিব? এছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা দেখে দেখে লিখছে তাতে কি লাভ হচ্ছে? তাই সরকারের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যখন করোনার ভয়াবহতা কিছুটা কম ছিল তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে আবার পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্ধ করতেও হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয়নি। তবে চাইলে আমরাও খুলতে পারতাম। আমাদের প্রচলিত চিন্তাভাবনার উর্ধ্বে উঠতে হবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং বিভিন্ন সময় বোর্ড পরীক্ষার মূল্যায়ন নিয়ে সরকার এক ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে এবং সিদ্ধান্তের বিপরীতেও অনেক উঠেছে। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
“করোনার এসময়ে শিক্ষার্থীরা কি চাচ্ছে, অভিভাবকদের মতামত, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটির মতামতসহ প্রত্যেকের মতামতকে নিরুপণ করা কিন্তু তেমন কঠিন কাজ না।সরকার যদি নিজের ঘাড়ে দোষ না নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের একটা ফরম দিয়ে তাদের মতামত নেওয়ার পরে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাহলে পক্ষে-বিপক্ষে এত প্রশ্ন উঠতো না৷”
তিনি আরও বলেন, করোনার কঠিন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মূল্যায়ন কিভাবে হবে সে ব্যপারে শিক্ষার্থীদের মতামত জরিপ করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা কিন্তু সরকারের একার সিদ্ধান্ত না। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করবে, নির্দেশনা দিবে, কিন্তু সরকার যাদের উদ্দেশ্য একটি সিদ্ধান্ত ছুড়ে দিবে তাদের প্রতিক্রিয়াকেও আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমরা এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার জন্য খুব সংক্ষিপ্ত একটি সিলেবাস ইতিমধ্যে তৈরি করেছি যেটা পরবর্তী ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে নেবার জন্য উপযোগী। সেই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসটাই আমরা এখন অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীদের করাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আশা ছিলো যে আমরা এসএসসির জন্য ৬০ দিন এবং এইচএসসির জন্য ৮৪ দিন সংক্ষিপ্ত সিলেবাসটাই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাতে পারবো কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতির ফলে তা আর সম্ভব হয়নি। তাই বর্তমানে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েই সেটি করছি আমরা। আমি আশা করছি এই অ্যাসাইনমেন্ট যদি শিক্ষার্থীরা একটু মনোযোগ দিয়ে করে সেক্ষেত্রে নভেম্বর মাসে যদি পরীক্ষা নিতে পারি আমরা সেই পরীক্ষাটা দিতে শিক্ষার্থীর তেমন একটা সমস্যা হবেনা৷