১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:০২

শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউটে কোটি টাকা নয়-ছয়, অভিযোগ দুদকে

শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউট  © টিডিসি সম্পাদিত

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউট দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হলেও প্রায় এক দশক ধরে কয়েকজন শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। নিয়ম না মেনে বিভিন্ন খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি আয়কর ফাঁকি, প্রশ্নপত্র প্রুফ ও মডারেশন খাতে অস্বচ্ছ ব্যয়সহ নানা অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এসব অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

২০২৫ সালের ১২ নভেম্বর দুদকে জমা দেওয়া ওই অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আবু সোলেমান ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আল আমিনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দরপত্র ছাড়াই বিদ্যালয়ের ভবনের ৪র্থ ও ৫ম তলার নির্মাণ ও সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা হয়। এসব কাজে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এসব ব্যয়ের কোনো সরকারি অনুমোদন বা নিরীক্ষা রেকর্ডপত্র নেই।

ট্রাস্ট পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আগে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হলেও ২০২৪-২৬ মেয়াদে প্রধান শিক্ষক নিজ পছন্দের শিক্ষক ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের তালিকা তৈরি করে সভাপতির অনুমোদন নিয়ে কমিটি গঠন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

২০২৪ সাল থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতি পরীক্ষায় ‘প্রশ্নপত্র প্রুফ ও মডারেশন’ খাতে প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করে উত্তোলন করা হচ্ছে। পরীক্ষার খাতায় ‘কোডিং’ নামের ভাউচার তৈরি করে এই অর্থ তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের নামে বড় অঙ্কের ভাউচার বানিয়ে স্বাক্ষর আদায় করা হয়েছে বলে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ।

২০১৭ সাল থেকে বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা, শিক্ষা সফর, বিদায় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হলেও এসব টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি। কিছু শিক্ষার্থীকে নানা অজুহাতে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিযোগ বলা হয়।

আরও পড়ুন: ঢাবির ভর্তি আবেদন শেষ আজই, আবেদন কমছে অর্ধলাখ

২০১৫ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই একাধিক চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালে তাদের স্থায়ী করা হয়। ওই তালিকায় রয়েছেন রাহিমা খানম (দিবা শাখা), অহিদুল্লাহ (প্রাতঃশাখা), রওশন আক্তার ও আশরাফ আলী। এসব শিক্ষকের কারও নিয়োগ বা যোগদানপত্র নেই।

প্রধান শিক্ষক প্রাতঃ ও দিবা শাখা থেকে বছরে প্রায় ১৭ লাখ টাকা আয় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব আয়ের কোনো কর তিনি পরিশোধ করেননি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ঘরভাড়া ৩ হাজার ও নন-এমপিও শিক্ষকদের ৪ হাজার টাকা হলেও প্রধান শিক্ষক উভয় শিফট থেকে ১৬ হাজার টাকা ঘরভাড়া নেন। সহকারী প্রধান শিক্ষকরা ‘বিশেষ ভাতা’ নামে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা করে পান।

এ ছাড়া ২০১৬ সাল থেকে অনুমোদন ছাড়াই প্রতিবছর টিউশন ফি বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি ১ হাজার টাকা, যা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অনুমোদনবিহীন। প্রধান শিক্ষক আবু সোলেমান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাউশি বা সরকার থেকে কোনো বরাদ্দের আবেদন করেননি। বরং প্রতিষ্ঠানটির টাকা দিয়ে নিজ আস্থাভাজন শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে উন্নয়ন কমিটি গঠন করে বিভিন্ন খাতে অর্থ আত্মসাৎ করার তথ্য উল্লেখ করেছে অভিযোগে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান রোডে শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউট ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর নামে নামকরণ করা বিদ্যালয়টি ১৯৯৩ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে দুই শিফটে পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন অন্তত ৫০ জন।

আরও পড়ুন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, জেনে নিন বিস্তারিত

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী জানিয়েছেন, বিভিন্ন নির্মাণ কাজের ব্যয় ভাউচারে তাদের জোর করে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। প্রধান শিক্ষক নাকি তাদের বলেছেন, ‘এগুলো চাকরির অংশ, স্বাক্ষর না করলে চাকরি থাকবে না। একসময় সুনাম ছিল এই প্রতিষ্ঠানের। এখন নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে কতিপয় শিক্ষকের এটিকে ব্যক্তিগত লাভের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউটের মুহাম্মদ আবু সোলেমানকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও সংযোগ তুলেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে অতিরিক্ত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি এখন দায়িত্বে নেই। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’ তবে নথিপত্রে দেখা যায়, গত ২ নভেম্বর শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইনস্টিটিউটের অক্টোবর মাসের ব্যয়ের হিসাব খাতায় তার স্বাক্ষর রয়েছে।