সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ চীনে, আবেদন ডিসেম্বরজুড়ে
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ PM , আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৫ PM
‘বিশ্বের কারখানা’ বলা হয় চীনকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি—বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। চার হাজার বছরেরও অধিক পুরনো এই সভ্যতা আবারও বিশ্বের বুকে নিজের জায়গা করে নিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নিজস্ব জ্ঞান আর প্রযুক্তি দক্ষতায় প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে নিজের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে বিশ্বমঞ্চে।
বিশ্ব মোড়লরা সামরিকভাবে চীনকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলেও চীন শান্তিপূর্ণভাবে নিজের উত্থান ঘটাতে সচেষ্ট। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি। এরই অংশ হিসেবে চীন সরকার প্রতিবছর বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়াশোনার সুযোগ প্রদানের পাশাপাশি অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে আসছে।
আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন অনেক পুরনো। তার নিদর্শন পাওয়া যায় প্রাচীন সাহিত্যেও। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন আমাদের দেশে পরিচিত নাম। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসকে চেনে না এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমার থিসিসের জন্য যখন চীনা প্রফেসরের সঙ্গে আলোচনা করি তখন স্বভাবতই আমাদের আলোচনায় উঠে আসে পন্ডিত অতীশ দীপঙ্করের নাম। এসব নির্দেশ করছে বাংলা-চায়নার মধ্যকার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন কতটা গভীর। আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত একটি প্রবাদ হলো: জ্ঞান অর্জনে সুদূর চীন দেশে যাও।
চীনে আমি কেন যাব?
আমার পাল্টা প্রশ্ন: চীনে আপনি কেন আসবেন না? "আসবেন না?" শব্দগুচ্ছ দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমি চীনে বসে এই লেখাটি আপনার জন্য লিখছি!
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেবল তথ্যের এবং যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে বঞ্চিত হয়। যদিও তথ্যের অভাব আজকাল অনেকটা কমে আসছে, তবুও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চীনের ব্যপারে আমাদের জানাশোনা এখনও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। "মেইড ইন চায়না বেশিদিন যায় না"-র কাল যে ইতোমধ্যে অতীত হয়ে গেছে সে খবর সারা দুনিয়ায় পৌঁছে গেলেও মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার দূরত্বের বাংলাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এখনও এ খবর পৌঁছায়নি যে, বিশ্বের এমন কোনো প্রান্ত নেই, যে প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা চীনে পড়াশোনার জন্য আসছে না। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়াসহ নানা দেশের শিক্ষার্থীরা চীনে পড়াশোনা করছে।
বিনা মূল্যে পড়াশোনার পাশাপাশি রয়েছে প্রতিমাসে মোটা অংকের একটি বৃত্তি। যা দিয়ে রাজার হালে সবচেয়ে উন্নতমানের জীবনযাপন করা যায় অনায়াসেই। সাজানো গোছানো, ছবির মতো চীনা শহর—নদী, সাগর আর পাহাড়ের মধ্যে কত মিতালি! নিজেকে বিশ্বমানের পড়াশোনা দিয়ে গড়ে তুলতে চীনা সরকার সুযোগ করে দিয়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের। প্রায় প্রত্যেক দেশের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ গ্রহণ করছে সানন্দে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কেন পিছিয়ে থাকবে!
যেখানে সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যে! নিজের জীবনযাপন শেষে কেউ ইচ্ছে করলে বৃত্তির টাকা থেকে পরিবারকেও সহায়তা করতে পারবে। যা নিজের মানসিক প্রশান্তিরও আনবে। অন্য কোথাও বিশেষত আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপে পড়াশোনা করতে গেলে যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হচ্ছে সেখানে চীন বিনা মূল্যে একই মানের—ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়েও ভালো মানের পড়াশোনার সুযোগ দিচ্ছে একেবারে বিনা মূল্যে! যেখানে অন্য কোথাও গেলে টিউশন ফি-র যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয় সেখানে টিউশন ফি আর নিজের ভরণপোষণের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা না থাকায় নিবিষ্টভাবে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া যায়। যেখানে অপেক্ষা করছে নিজেকে বিশ্বমানের নাগরিক করে গড়ে তোলার অবাধ সুযোগ। পড়াশোনা শেষে যার জন্য উন্মুক্ত গোটা দুনিয়া!!!
চায়নিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ
চীন থেকে প্রতিবছর বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য অসংখ্য স্কলারশিপ দেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে সবচেয়ে সম্মানজনক, সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ হলো চীনা সরকারি বৃত্তি। যা চীন সরকার চায়না স্কলারশিপ কাউন্সিলের (সিএসসি) মাধ্যমে দিয়ে থাকে।
সিএসসি ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যা টাইপ-এ, টাইপ-বি এবং টাইপ-সি নামে পরিচিত।
টাইপ-এ
সরকারি স্কলারশিপের মধ্যে প্রথমেই আসে টাইপ-এ স্কলারশিপের নাম। এটি মূলত চীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। এটি প্রতিবছর দেশ ভেদে কম বা বেশি হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ৫০ থেকে ৬৫ এর মধ্যে ওঠানামা করছে।
প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চায়নিজ দূতাবাসে আবেদন করতে হয়। প্রাথমিক বাছাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় করে দূতাবাসে সাবমিট করে। দূতাবাস ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে সিলেক্টেড প্রার্থীদের জন্য সিএসসির কাছে রিকমেন্ডেশন পাঠায়। এ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসে অনলাইনে আবেদন করতে হয়।
আবেদনের সময়
সাধারণত নভেম্বর মাসেই বাংলাদেশর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে এ বৃত্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে আবেদন সম্পন্ন করতে হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে আবেদনবিষয়ক দরকারি সব তথ্য জানা যাবে।
সুযোগ সুবিধা
*আবেদন ফি মওকুফ;
*টিউশন ফি মওকুফ;
*আবাসন ফি মওকুফ;
*স্বাস্থ্যবীমা ফি দেবে;
*প্রথমবার চীনে যেতে ও পড়াশোনা শেষে দেশে ফেরার বিমান টিকিট;
বৃত্তির পরিমাণ
*স্নাতক পর্যায়ে: ২৫০০ ইউয়ান (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৫ হাজার টাকার ওপরে);
*স্নাতকোত্তর পর্যায়ে: ৩০০০ ইউয়ান (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ হাজার টাকা);
*পিএইচডি পর্যায়ে: ৩৫০০ ইউয়ান (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬৪ হাজার টাকা);
টাইপ-বি
এ বৃত্তি পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সিএসসির কাছে আবেদন করতে হয়। চীনা সরকারি বৃত্তি বলতে শিক্ষার্থীরা টাইপ বি-কেই বেছে নেয়। কারণ টাইপ এ-অনেক প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে থাকে সিট সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে।
আবেদনের সময়
সিএসসি টাইপ-বি এর আবেদনের সময় একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক। সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হয়ে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত চলে। তবে যত আগে আবেদন করা যায় স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়ে।
সুযোগ-সুবিধা
টাইপ-এ এবং টাইপ-বি এর সুযোগ-সুবিধা প্রায় একই রকম। প্রথমটিতে বিমান টিকিট দূতাবাস থেকে পাওয়া যায়, দ্বিতীয়টিতে পাওয়া যায় না।
আবেদনের যোগ্যতা
*নন-চায়নিজ হতে হবে;
*চীনের অন্য কোনো স্কলারশিপ পেলে আবেদন করা যাবে না;
*স্নাতকের জন্য বয়স সর্বোচ্চ ২৫ বছর;
*স্নাতকোত্তরের জন্য বয়স সর্বোচ্চ ৩৫ বছর;
*পিএইচডির জন্য বয়স সর্বোচ্চ ৪০ বছর;
একাডেমিক যোগ্যতা
*স্নাতক শ্রেণির জন্য এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পাস হতে হবে;
*স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতক পাস হতে হবে;
*পিএইচডির জন্য স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হতে হবে;
দরকারি কাগজপত্র
*বৈধ পাসপোর্ট থাকতে হবে;
*সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রির সত্যায়িত ট্রান্সক্রিপ্ট ও সনদ;
*মেডিকেল সনদ অথবা বিদেশি স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফরম (৬ মাস সময়ের মধ্যকার);
*পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত (সিভি);
*দুইটি রিকমেন্ডেশন লেটার;
*স্টাডি প্ল্যান/রিসার্চ প্রপোজাল;
*আইইএলটিএস/টোয়েফল/এইচএসকে সার্টিফিকেট;
*পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থাকতে হবে;
মোটাদাগে উপর্যুক্ত সব কাগজপত্র প্রয়োজন হয় আবেদনের ক্ষেত্রে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চীনে দিন দিন বাংলাদেশিসহ বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নিজের ও পরিবারের স্বপ্ন পূরণে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আরও ব্যাপকহারে চীনে আসবে-এটাই কামনা করি।
সিএসসি-এ ক্যাটাগরির আবেদন পদ্ধতি
যদি আপনি চীনে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে এখানে আপনাকে সিএসসি-এ ক্যাটাগরিতে আবেদনের স্টেপ-বাই-স্টেপ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো...
চলুন আবেদন শুরু করি;
প্রথম ধাপ: "CSC Study in China" ওয়েবসাইটে গিয়ে "Scholarship Application for Students"-র http://www.campuschina.org–এ গিয়ে "CREATE AN ACCOUNT"-এ অ্যাকাউন্ট খুলে লগ ইন করুন।
দ্বিতীয় ধাপ: আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ইনপুট করুন। "Edit Personal Details"-এ ক্লিক করে আপনার প্রদেয় সব তথ্য প্রদান করুন। এই সেকশন শেষ করে "Finish"-ক্লিক করে আগের পেইজে ফিরে যান এবং আবেদনের তথ্য পূরণ করুন।
তৃতীয় ধাপ: সঠিক ক্যাটাগরি বাছাই করুন। আপনার ক্যাটাগরি " Type-A".
চতুর্থ ধাপ: সঠিক এজেন্সি নম্বর প্রদান করুন। আপনার এজেন্সি নম্বর 0501. টাইপ এবং এজেন্সি নম্বর না মিললে কর্তৃপক্ষ আপনার কোনো তথ্য পাবে না। এ জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ীও থাকবে না।
পঞ্চম ধাপ: "Language Proficiency and Study Plan"-এ গিয়ে সব "Supporting Documents" প্রদান করুন যেগুলো চাওয়া হয়েছে। "Submit" ক্লিক করে আবেদন সম্পন্ন করুন। তার আগে ভালোভাবে সব পদ্ধতি ও দরকারি কাগজপত্র চেক করে নিন। "Preferences of Institutes"-এর জন্য Type A-আবেদনকারীরা তাদের ভাষা ও ক্যাটাগরি মিলে যায় করে এমন প্রতিষ্ঠান দেখবে। এ ছাড়াও অন্যান্য ওয়েবসাইট থেকেও কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠান খুঁজে নেওয়া যাবে। নিজের প্রোফাইলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে হবে। কারণ দূতাবাস কর্তৃক রিকমেন্ডেড হলেও প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে না পারলে স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যাবে।
ষষ্ঠ ধাপ: আবেদনপ্রক্রিয়া প্রসেস হওয়ার আগ পর্যন্ত "Withdraw" ক্লিক করে এডিট করা যাবে। তবে অবশ্যই আবার সাবমিট করতে হবে।
সপ্তম ধাপ: "Print the Application Form"-এ ক্লিক করে আবেদন ফরম ডাউনলোড করুন।
আবেদন ও চায়নিজ স্কলারশিপ সম্পর্কিত বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
আপনার জন্য শুভকামনা...
মাহবুবুল হাসান
শিয়ামেন ইউনিভার্সিটি ,ফুজিয়ান, চায়নার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী