চীনে উচ্চশিক্ষা: স্কলারশিপের সঙ্গে থাকছে চাকরি-স্থায়ী হওয়ার সুযোগ
সাশ্রয়ী অথচ উন্নত মানের শিক্ষায় শুধু ইউরোপই নয়; এগিয়ে রয়েছে এশিয়ার দেশগুলোও। পৃথিবীর বৃহত্তম এ মহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের প্রথম সারির বিদ্যাপীঠগুলোর তালিকায়। এগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা এগিয়ে চীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যুগ যুগ ধরে স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ নিয়ে দেশটি স্বাগত জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের। চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন ও স্কলারশিপসহ প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
কেন চীন অন্যতম সেরা গন্তব্য:
সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ চীন। আর্থসামাজিক দিক থেকেও দেশটিতে জীবনধারণের মান এশিয়ার অন্য দেশ থেকে অনেকটা উন্নত। দেশটির অপরাধ সূচক ২৪ দশমিক ৪ এবং শান্তি সূচক ২ দশমিক ১০১। এশিয়ায় অন্যতম বিদ্যাপীঠ পিকিং ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ড কিউএস র্যাংকিং-এ ১৭ নম্বরে। সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির অবস্থান ২৫ এবং ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি রয়েছে ৪৪ নম্বরে। ৫০তম স্থানে আছে ফুডান ইউনিভার্সিটি আর তার পরেরটি সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি।
চীনে আবেদনের পূর্বশর্ত:
স্নাতকে ভর্তির জন্য ডিপ্লোমা, উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের সনদধারী হতে হবে। স্নাতকোত্তরের জন্য লাগবে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি। অপর দিকে স্নাতকোত্তর শেষ করে আবেদন করা যাবে পিএইচডির জন্য।
আরও পড়ুন: বিনা খরচে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ুন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে
এমবিএর জন্য স্নাতকের পাশাপাশি দরকার হবে দুই বছর বা তার বেশি কাজের অভিজ্ঞতা। অতিরিক্ত সংযুক্তি হিসেবে জিম্যাট বা জিআরই স্কোরের প্রয়োজন হতে পারে। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রবেশিকা পরীক্ষা বা অনলাইন সাক্ষাৎকার নিতে পারে। ইংরেজি ভাষা যোগ্যতার জন্য আইইএলটিএস একাডেমিক বা টোফেল আইবিটি আবশ্যক।
চীনে আবেদনের উপায়:
সাধারণত প্রতিবছর দুটি মৌসুমে ভর্তি নেয় চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর একটি হলো মার্চে, যার সময় শেষ হয় পরের বছরের সেপ্টেম্বরে। আর দ্বিতীয়টি হলো সেপ্টেম্বরে, যার সময়সীমা থাকে পরের বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরের সময়টিতে মার্চের তুলনায় বেশি কোর্স এবং স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ থাকে।
সাধারণত দুটি উপায়ে ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়। একটি হলো সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পোর্টালে বা ই-মেইলের মাধ্যমে। আরেকটি হলো সিইউসিএএসের (ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ অ্যাডমিশন সিস্টেম অব চীন) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ইন্টার্নশিপের সুযোগ দিচ্ছে জাপান
সিইউসিএএস প্ল্যাটফর্মটি মূলত শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। এটি কেবল আবেদনই নেয় না; বরং কোর্স ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথি আপলোড, আবেদন ফি প্রদান, আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা জানা এবং জেডব্লিউ ২০২ ফরম প্রাপ্তি সবই করা যায় এই পোর্টালে।
জেডব্লিউ ২০২ ফরম: যে বিদেশি শিক্ষার্থীরা ১৮০ দিনের বেশি সময় নিয়ে চীনে পড়তে আসেন, তাঁদের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ফরম জারি করা হয়। এর আওতাভুক্ত প্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছে ফুলটাইম ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি প্রোগ্রাম এবং এক বছরের ভিজিটিং বা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম। ভর্তির আবেদন অনুমোদিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পোর্টাল থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে জেডব্লিউ ২০২ ফরম পাঠানো হয় প্রার্থীকে। এটি প্রিন্ট করে পরবর্তী ভিসা–সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা যায়। এখানে উল্লেখ্য, ফরম প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য অবশ্যই ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করা আবশ্যক। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট দিয়ে এই প্রক্রিয়া সম্পাদন করা যাবে না।
আবেদনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
উচ্চমাধ্যমিক বা ডিপ্লোমা অথবা সমমানের পরীক্ষা সনদ ও মার্কশিট (স্নাতকের জন্য);
* স্নাতক সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট (স্নাতকোত্তর বা পিএইচডির জন্য);
* বৈধ পাসপোর্টের ফটোকপি;
* পাসপোর্ট সাইজের ছবি;
* ইংরেজি ভাষা দক্ষতার সনদ (আইইএলটিএস একাডেমিক বা টোফেল আইবিটি স্কোর);
* রিকমেন্ডেশন লেটার (স্নাতকোত্তর বা পিএইচডির জন্য);
গ্যারান্টি লেটার (শিক্ষার্থীর মা–বাবা বা অভিভাবকের সই করা একটি ঘোষণাপত্র যেখানে উল্লেখ থাকবে যে তিনি/তাঁরা শিক্ষার্থীর চীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ও প্রবিধান মেনে চলার দায়িত্ব নিয়েছেন)।
গবেষণা প্রস্তাব (পিএইচডির জন্য)।
ভর্তি ফি পরিশোধের রসিদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেদে ফি সাধারণত ৮০ থেকে ১৫০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয়ে থাকে।
স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদনের উপায়:
স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা পিএইচডির মতো দীর্ঘমেয়াদি স্টাডি প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে চীনের এক্স-১ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। এই ভিসার মাধ্যমে ৬ মাস বা ১৮০ দিনের বেশি চীনে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়।
চীনে প্রবেশের নির্ধারিত তারিখের ন্যূনতম এক মাস আগে থেকে এই ভিসার জন্য আবেদন করা উচিত। তবে তিন মাস আগে থেকে আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করা ঠিক নয়। কেননা, এ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে চীনে প্রবেশের মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ তিন মাস (কর্মদিবস গণনার সাপেক্ষে)। সে ক্ষেত্রে খুব আগে আবেদন করার পরেও দেশ ত্যাগের আগেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে পারে। যেমন উদ্দেশ্য যদি হয় পয়লা অক্টোবর চীনে প্রবেশ করা, তাহলে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার সর্বোত্তম সময় হবে পয়লা সেপ্টেম্বরের কাছাকাছি কোনো সময়ে।
আরও পড়ুন: জাপানে স্নাতকোত্তর করুন টিউশন ফি ছাড়াই, থাকছে আবাসন ভাতা
এক্স-১ ভিসার আবেদন করতে হবে সম্পূর্ণ অনলাইনে। এর জন্য চীনা ভিসা সেন্টারের ওয়েবসাইট -এ গিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। অতঃপর প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে পুরো অনলাইন আবেদনটি সম্পন্ন করতে হবে।
পরিশেষে ‘পাসপোর্ট টু বি সাবমিটেড’ স্ট্যাটাস প্রদর্শন করলে আবেদনপত্রের প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠাটির একটা প্রিন্ট নিতে হবে। শেষ পৃষ্ঠায় আবেদনকারী স্বহস্তে তারিখসহ সই করবেন।
চীনে পড়াশোনার পর চাকরি লাভ ও স্থায়ী হওয়ার সুযোগ:
চীনে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিকে বলা হয় ডি টাইপ ভিসা। এ ভিসায় ১৮ বছরের কম বয়সীরা ৫ বছর এবং প্রাপ্তবয়স্করা ১০ বছর চীনে বসবাসের অনুমতি পান। এই পারমানেন্ট রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদনপ্রক্রিয়ায় খরচ হবে ১ হাজার ৮০০ ইউয়ান (প্রায় ২৯ হাজার ৫৮৪ টাকা)। এ ছাড়া এর জন্য কিছু শর্ত রয়েছে—
প্রার্থীকে ওয়ার্ক পারমিট থাকা অবস্থায় ন্যূনতম চার থেকে পাঁচ বছর চীনে থাকতে হবে এবং তাঁকে অবশ্যই একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হতে হবে।
প্রার্থীকে তাঁর কাজের মাধ্যমে চীনের যেকোনো সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে হবে।
উপরন্তু বছরে একটানা অন্তত ৯ মাস চীনের বাইরে যাওয়া যাবে না।
ওয়ার্ক পারমিটের প্রথম শর্ত হলো একটি চাকরি জোগাড় করা বা নিজের ব্যবসা শুরু করা। এ শর্ত পূরণের সময়ের জন্য অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাঁদের স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে পারে। এর জন্য মেয়াদ শেষ হওয়ার সাত দিন আগেই তাদের পিএসবি (পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরো এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস) বরাবর আবেদন করতে হবে।
আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করুন বিনা খরচে
ওয়ার্ক পারমিটে মূলত পয়েন্ট সিস্টেমের ভিত্তিতে টিয়ার-এ, বি এবং সি—এই ৩ স্তরের ভিসা দেওয়া হয়। ভিসার স্তর নির্ধারণ করা হয় প্রার্থীর যোগ্যতা, বয়স, কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং বার্ষিক বেতনের ভিত্তিতে।
স্নাতক শেষে শিক্ষার্থীরা এই টিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন। প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে এক বছরের ভিসার বৈধতা দেওয়া হবে। এর পর পর্যায়ক্রমে তিনি আরও এক বছরের জন্য ভিসা রিনিউ করতে পারবেন। এভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
যেকোনো টিয়ার ভিসার জন্য এসএএফইএ (স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব ফরেন এক্সপার্ট অ্যাফেয়ার্স) নিয়ন্ত্রিত অনলাইন প্ল্যাটফর্মের (ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস সিস্টেম) মাধ্যমে আবেদন জমা দিতে হয়।
চীনে ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের জন্য আকর্ষণীয় বেতনের চাকরির সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে প্রযুক্তি, ফাইন্যান্স, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রকৌশলের মতো খাতে। চীনের শীর্ষ নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলিবাবা, টেনসেন্ট, হুয়াওয়ে, বাইদু ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক। এগুলোতে মাসিক বেতন কমপক্ষে ২৫ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৮৫ হাজার ইউয়ান পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার ৮৭৮ থেকে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৯৮৫ টাকার সমান।
তথ্যসূত্র: ইউএনবি নিউজ