অধিভুক্তির ৪ বছরেও গতি ফেরেনি সাত কলেজে

  © লোগো

ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তির চার বছর পূর্ণ হলো আজ। শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। এই সাতটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নরত  রয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী।

তবে  শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পেরুলেও  নানান জটিলতায় অধিভুক্তির মূল উদ্দেশ্য ‘শিক্ষার মানোন্নয়ন’ অর্জন করতে সাত কলেজ সক্ষম হয়নি বলে অভিযোগ সাধারন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে কোনরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই অধিভুক্ত হওয়ার পর প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার দরুন দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস বন্ধ ছিলো সাত কলেজের সকল কার্যক্রম। যার ফলে শুরু হয় চরম সেশনজট।

এরপর স্থবির কার্যক্রমে কিছুটা গতি আসলেও যোগ হয় নতুন সমস্যা। দেরিতে পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জটিলতা, ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা, গণহারে ফেলসহ নানাবিধ সমস্যায় হাবুডুবু খেতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এসব সমস্যা সমাধানের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের আঘাতে দুই চোখের জ্যোতিও হারাতে হয় সরকারি  তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানকে।

দীর্ঘ চার বছর পেরুলেও এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি সেশনজট। নানান জটিলতায় নির্দিষ্ট সময় পেরুলেও আটকে আছে অনেক শিক্ষার্থী। মাস্টার্স ১ম পর্ব ১৬-১৭ সেশনের পরীক্ষা নিয়ম অনুযায়ী ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠিত হয়নি এখনো। ডিগ্রি ১৬-১৭ সেশনের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা নিয়ম অনুযায়ী ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এখনও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এছাড়াও সেশনজটে নাকাল স্নাতক ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থীরা। এই দুই বর্ষের শিক্ষার্থীদের ইতোমধ্যে স্নাতক সম্পন্ন করার কথা থাকলেও ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা মাত্র চতুর্থ বর্ষ সমাপণী পরীক্ষা এবং ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থীরা মাত্র তৃতীয় বর্ষ সমাপণী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে।

এ বিষয়ে তিতুমীর সরকারি কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, পড়াশোনার মানোন্নয়ন দূরে থাক আমরা এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পিছিয়ে গিয়েছি। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন একাডেমিক ক্যালেন্ডার আমরা পাইনি। সমস্যার সমাধানে নেই কোন ডেডিকেটেড ডেস্ক। প্রশাসন যদি আন্তরিক না হয় তবে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হবে। সবার আন্তরিকতা থাকলে সমস্যার সমাধান সম্ভব।

ঢাকা কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়েই ভর্তি হই ঢাকা কলেজে৷ ঢাকা কলেজ তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল৷ ভর্তির কিছুদিন পর জানতে পারেন ঢাকা কলেজসহ রাজধানীর মোট সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে৷ শিক্ষার মানোন্নয়নে এমন উদ্যোগে প্রথমে বেশ আনন্দিত হলেও তা বিষাদে রুপ নিতে বেশিদিন সময় লাগেনি৷ দেরিতে পরিক্ষা নেয়া, ফল প্রকাশে দীর্ঘ সূত্রিতা, সেশন জটসহ অন্যান্য সব সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ পড়াশোনা এখন গলারকাঁটায় পরিণত হয়েছে। কলেজ থেকে ইস্যু করা আইডি কার্ডের মেয়াদও ইতিমধ্যেই শেষ। কলেজ থেকে কার্ডটি ইস্যু করা হয় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আর এর মেয়াদ ২০২০ সালের জুনে শেষ হয়েছে৷ সেই অনুযায়ী চলতি বছরের জুনের মধ্যেই স্নাতক শেষ হওয়ার কথা অথচ মাত্র তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হলেও স্নাতক শেষ করতে বাকি এখনও পুরো এক বছর ৷ চার বছরের স্নাতক কোর্স শেষ করতে কতবছর সময় লাগবে তা আমরা কেউ জানিনা।

তবে সেশনজট নেই অধিভুক্ত হওয়ার পর ভর্তি হওয়া সেশনগুলোতে। অনার্স ২০১৭-১৮ সেশনের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ এবং ১৮-১৯ সেশনের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে যথাসময়ে। কিন্তু এসব শিক্ষাবর্ষে গণহারে ফেইল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রচুর। ফলাফলের চরম বিপর্যয় যেনো পিছু ছাড়ছে না এই দুই বর্ষের শিক্ষার্থীদের। গত বছরের ৩১ আগষ্ট সরকারি সাত কলেজের ২০১৮ সনের চতুর্থ বর্ষের ইংরেজি বিভাগের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। প্রকাশিত ফলাফলে ছিল চরম বিপর্যয়। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাত কলেজের মোট ৮৮৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৮৪ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। পাসের হার ছিল মাত্র ৩২%। এরমধ্যে সরকারি তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের ২০৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে শুধুমাত্র ‘আমেরিকান পোয়েট্রি’ বিষয়েই ফেল করে ১০৮ জন শিক্ষার্থী। এরপর বিভাগ কর্তৃপক্ষ এই সাবজেক্টের খাতা পুনঃ মূল্যায়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে খাতা পুনঃমূল্যায়নে ফেল করা ৩৪ জন শিক্ষার্থীর পাস আসে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর সালেকা মাহমুদ এ বিষয়ে  বলেন, আমাদের বিভাগ থেকে আমরা অধ্যক্ষের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর খাতা পুনঃ মূল্যায়নের আবেদন করেছি। এতে আমার জানামতে ৩৪ জন শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।

প্রথমে ফেল পরে পাস! এমনটা হবার কারণ কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা এর সাথে সম্পর্কিত তারা এটার কারণ  ভালো বলতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খাতা মূল্যায়ন সহ সবকিছু দেখাশুনা করে।

ফলাফল বিপর্যয়ে পিছিয়ে নেই ঢাকা কলেজও। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ১ম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফলেও ঘটেছে ব্যাপক বিপর্যয়। শিক্ষার্থীরা জানান, প্রায় ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সকল বিষয়ে পাশ করেছ মাত্র ২৭-৩০ জনের মতো শিক্ষার্থী। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই অভিযোগ করছেন, প্রশাসনের গাফিলতির জন্যই এমন ভয়াবহ বিপর্যয়। কি কারণে এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেইল করেছে তার কারণও অজানা।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে আলাদা ‘ডেডিকেটেড ডেস্ক’ চালুর করার দাবি ছিলো দীর্ঘদিনের।  ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু করাসহ অন্যান্য সমস্যার যথাযথ সমাধানের দাবিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে  নীলক্ষেত অবরোধ করে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা৷ এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেয়৷ অধিভুক্ত এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ নিজ কলেজে ‘ডেডিকেটেড ডেস্ক’ বসানো হবে বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ৷

তবে কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত কাগজেকলমেই আটকে যায়। গত দেড় বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি৷ ভুল ফলাফল প্রকাশ আগের মতই রয়েছে৷ পরীক্ষা দিলেও ফলাফল প্রকাশের পর অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফলে এক বা একাধিক বিষয়ে  অনুপস্থিত দেখায়৷

এতে ভুক্তভোগী ঐ শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে হাজিরা খাতার ফটোকপি সংগ্রহ করে লিখিত আবেদন সহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে হয়৷ শিক্ষার্থীর লেখা ঐ আবেদনপত্রে নিজ কলেজের অধ্যক্ষের স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷

ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন তাঁদের কলেজের অফিস সহায়করা ও পুরোপুরি জানেনা এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের৷ আবেদন জমা দেয়া বা অফিসিয়ালি কাজের জন্য তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়েই যেতে হচ্ছে৷

কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলেছিল, ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু হলে শিক্ষার্থীর আবেদন জমা বা অফিসিয়ালি কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে না৷ শিক্ষার্থীরা তাদের কাগজপত্র নিজ কলেজের ডেডিকেটেড ডেক্সের দায়িত্বে থাকা অফিস সহায়কের কাছে জমা দিলেই তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে যাবে৷

অধিভুক্ত বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া শারমিন বলেন, ফলাফল সমন্বয়ের আবেদন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে করতে হয়েছে৷ অথচ ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু থাকলে সেটা কলেজে জমা দিলেই হতো৷ দীর্ঘদিনেও এটা চালু হয়নি৷ আমরা চাই প্রত্যেক কলেজে এটা চালু হোক যাতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমে৷

কোভিডকালীন সময়ে ফলাফল সমন্বয়ের আবেদন প্রক্রিয়াটি অনলাইনে করার সুবিধা চালু করা হলেও শিক্ষার্থীদের দাবি যেন অতি শীঘ্রই ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু করা হয়।

২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু করাসহ নানন দাবিতে সংগঠিত ঐ আন্দোলনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবু বকর ৷ তিনি বলেন, এত দিনেও ডেডিকেটেড ডেস্ক চালু না হওয়া দুঃখ জনক৷  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে এটা করবে৷ কিন্তু আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ এটা করেনি৷ আমরা চাই এটা দ্রুত চালু হোক৷

অবশ্য কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে৷ তাঁরা বলছেন লোকবল সংকটে তাঁরা ‘ডেডিকেটেট ডেস্ক’ চালু করতে পারছেন না৷

এর বাইরে নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, ক্লাসরুম সংকটসহ নানান সমস্যার কথাও জানান শিক্ষার্থীরা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজে রয়েছে শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকট।


তবে শিক্ষার্থীদের এতসব অভিযোগ মানতে নারাজ সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়ক এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি বলেন, সেশনজট সমস্যা আমরা কাটিয়েই উঠছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে আবারও সেই সমস্যা সামনে চলে এসেছে। আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা একা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় দুটোই দিকই দেখতে হয়। সাত কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে আমরা সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। খুব দ্রুতই এসব সমস্যার সমাধান হবে। স্বাভাবিক গতিশীলতা ফিরে আসবে।

এছাড়াও সাত কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ানো সহ সরকারের বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক৷


সর্বশেষ সংবাদ