জীবনের জন্য ৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দিলেন তিন তরুণ

  © টিডিসি ফটো

পারিবারিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর সীমান্তে ভিনদেশী বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে জীবন নিতান্তই মূল্যহীন। এই জীবনের গুরুত্ব ও মূল্যবোধ উপলব্ধি করে পারিবারিক সহিংসতা, সীমান্তে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সর্বোপরি হত্যার বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে ৩০০ কিলোমিটার পায়ে হেটে প্রচারণা চালিয়েছে ৩ তরুণ।

তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বিডি রায়হান। রায়হানের গ্রামের বাড়ি বরিশালে হলেও বেড়ে উঠা ঢাকায়। বাকি দু’জন হলেন, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় আলিম পড়ুয়া মোহাম্মদ রাফী ও রংপুরের ছেলে আশরাফি আরাফাত আকাশ। তাদের পরিচয় হয়েছিল বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ-সাহায্য দিতে গিয়ে।

ব্যতিক্রমী সীমান্ত সড়ক হাইকিং করতে তারা বেছে নিয়েছেন জামালপুরের লাউচাপড়া থেকে শুরু করে সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত। আর এ মিশনের নাম দেয়া হয়েছে ‘হাইকিং ফর লাইফ’। রায়হান বলছেন, ‘এটাই তার জীবনের প্রথম হাইকিং ছিল, তার উপর সম্পূর্ণ নতুন রুট। খুব কম মানুষের এই অনন্য রুটের বিষয়ে ধারণা আছে।’

তারা জানান, গত ৩১ আগস্ট সকাল ৯টায় জামালপুরের লাউচাপড়া থেকে শুরু করে ৯ সেপ্টেম্বর (বুধবার) বিকাল ৪ টায় সিলেটের তামাবিল জিরো পয়েন্টে গিয়ে হাইকিং মিশন শেষ হয়েছে তাদের৷ যাত্রাপথ ছিল জামালপুরের লাউচাপড়া থেকে শুরু করে শেরপুরের ঝিনাইগাতি, রাংটিয়া। সেখান থেকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট হয়ে, নেত্রকোনার দুর্গাপুর বিরিশিরি-কলমাকান্দা।

পরে কলমাকান্দা থেকে সুনামগঞ্জের নীলাদ্রি লেক-শিমুল বাগান-লাউরেরগড়- মথুরাকান্দি-ডলুরা-খাগেরগাও। সেখান থেকে বঙুয়া বাজার- চান্দপুর- বাংলাবাজার - চারগাঁও বাজার -বনগাঁও বাজার হয়ে সিলেটের বিছানাকান্দি-জাফলং হয়ে তামাবিল জিরো পয়েন্টে শেষ হয়।

হাইকিং-এর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানচিত্রের উত্তরে, ভারতের মেঘালয়ের তীর ঘেষে বর্ডার রোডে হাইকিং করাটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। অন্যান্য হাইকিং র‍্যুটের মত এই হাইকিং র‍্যুট সমতল, পাকা রাস্তা ছিল না। কখনো ছোট টিলা, কখনো কাদা রাস্তা, কখনো খাল, কখনো নদী পার হতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২৫টির উপর নদী পার হয়েছি, যার মধ্যে অনেকগুলোতে নৌকা ছিল না বলে গলা সমান পানিতে ভিজে পার হতে হয়েছে। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে, কখনো রোদে পুড়ে, কখনো আহত পা নিয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত হাইকিং করেছি৷’

চলতি পথে তারা গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে, সীমান্তবর্তী বাজারে আর পথচারীদের মধ্যে প্রচারণা চালিয়েছেন তিনটি প্রতিপাদ্য বিষয়। সেসব হলো- 
১. #Stop_Border_Killing
২. #Extrajudicial_Killing_is_Injustice
৩. #Stop_Domestic_Violence

রংপুরের ছেলে আশরাফি আরাফাত মূলত একজন সংগঠক। বাবার ব্যবসা দেখাশুনার পাশাপাশি কাজ করেন নানান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে। সেরকম এক সংগঠনে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় রায়হানের সাথে।

হাইকিং অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আরাফাত বলেন, ‘দীর্ঘযাত্রায় যে শ্রম আর সময় আমরা দিয়েছি তার পুরোটাই ছিল উপভোগ্য। পথে পথে মানুষ আমাদের ঘিরে ধরছিল। অনেকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনমত গড়তে গিয়ে।’

১০ দিনে তারা সর্বমোট হেটেছেন ৮০ ঘন্টা ৩০ মিনিট। যেখানে অতিক্রম করেছেন জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট জেলার সীমান্ত এলাকা।

জনমত গঠনের বিষয়ে রায়হান বলেন, ‘আজ থেকে ২০ বছর আগে বাল্যবিয়ের যে হারটা ছিল এখন কিন্তু সেটা কমে এসেছে। কারণ এর বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা হয়েছে, জনমত গঠন করা হয়েছে। তেমনিভাবে আমরাও একটা জনমত গঠন করতে এসেছি। এভাবে হত্যাকাণ্ড একটা সভ্য সমাজে চলতে পারে না, আমরা মানুষের মাঝে সে জনমত বা সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছি।’

একেকটা হত্যাকাণ্ড একটা পরিবারে যে বিভীষিকা নামিয়ে আনে, সেটা শুধু ভুক্তভোগী পরিবারের মানুষজন হাড়েহাড়ে টের পাবেন। যেখানে পরিবারের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে যায়, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা পরে। হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের তাৎপর্য সেভাবে দেখছেন ঢাকা আলিয়ার শিক্ষার্থী রাফি।

তার ভাষায়, ‘সীমান্তে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হত্যাকাণ্ড শুধু নয়, পারিবারিক যে সহিংসতা সেটা দিনকে দিন বাড়ছে। মানুষ যদি সচেতন হয়, জেগে ওঠে হত্যাকাণ্ড নামের বর্বরতা একদিন বন্ধ হবে।’

স্থানীয় মানুষদের ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলেন, তাদের সহযোগিতা না পেলে কখনোই এই মিশন সফল হতো না। বিভিন্ন রাত কাটিয়েছি অপরিচিত মানুষের বাসায়, কখনো তাবু করে কিংবা ডাক বাংলোতে।

এর আগে রায়হান ‘একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে’ ও ‘রক্ত দিন, জীবন বাঁচান’ স্লোগানে মানুষের মধ্যে রক্তদানে সচেতনতা বাড়াতে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেন। তবে এবারের যাত্রা তার (রায়হানের) পরবর্তী মিশন ‘Walk for Climate Change’ এর জন্য প্রাথমিক ট্রায়াল বলে জানিয়েছেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ