ভবিষ্যতে নির্দেশ না মানলে ‘চরম পরিণতি’ ভোগ করতে হবে—শিক্ষার্থীকে ছাত্রদল নেতা
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) শেরে-বাংলা হলের দুই শিক্ষার্থীকে গতকাল মধ্যরাতে রুম থেকে ডেকে নিয়ে হেনস্তা ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নবনির্বাচিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থী সোমবার (১৫ নভেম্বর) পৃথকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্ট বরাবর বরাবর তিনটি আলাদা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থী হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান ফয়সাল বাদশা ও আইন বিভাগের এস. এম. ওয়াহিদুর রহমান।
শিক্ষার্থী ফয়সাল বাদশা অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করেন, শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাত ১টার দিকে রুমের সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা সোহানুর রহমান সিফাত (মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, ২০১৯-২০ সেশন)-এর নেতৃত্বে আহসান উল্লাহ্ (মার্কেটিং বিভাগ: ২০১৯-২০ সেশন), আকিবুর রহমান (ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ: ২০১৯-২০ সেশন) সহ আরও অজ্ঞাত ৫-৬ জন আমাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় জোরপূর্বক রুমের সমানে থেকে ধরে শেরে বাংলা হলের নিচে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ১৯তম শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি কবে, যা জানালেন এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান
আমি যখন কাপড় পরিধানের সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করি, তখন আমাকে কাপড় পড়ার সুযোগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এই তীব্র শীতের মধ্য টেনে হিঁচড়ে খালি গায়েই নিয়ে যায়। হলের গেটে গিয়ে আমি যখন বলি যে একা আমাকে আপনারা এতগুলো মানুষ আমাকে এভাবে জোর করে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তখন একজন বলে ওঠে, ‘তুই কারে ফোন দিবি দে, দেখি তোর কে আছে।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, এক পর্যায়ে তারা আমাকে শেরেবাংলা হলের সামনের বেঞ্চে বসিয়ে বিভিন্ন অসংলগ্ন প্রশ্ন করা শুরু করে এবং বলতে থাকে যে, ‘হলে তোর লিগ্যাল সিট নেই। তুই অবৈধ স্টুডেন্ট। তুই কেন অভিযোগ দিতে মুক্তমঞ্চে যাবি, তুই শিবির করিস?’ এরপর হলের ফেসবুক গ্রুপে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের কুরআন বিতরণ ও নবীনবরণ এর পোস্ট শেয়ার করা নিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে বলে, ‘এটা কি শিবিরের গ্রুপ পেয়েছিস? এগুলো কেন দিস? তুই শিবির করিস?’ এবং সেখানে সবাই বিভিন্নভাবে আমাকে মানসিক টর্চার করে। এক পর্যায়ে আমাকে তাদের সবার কাছে মাফ চাইতে বাধ্য করে। প্রায় ৪৫ মিনিট এর মতো আমাকে এভাবে হেনস্তা করতে থাকে।
এরপর তারা আমাকে ছাত্রদলের নবনির্বাচিত সভাপতি মো.মোশাররফ হোসেন (ইতিহাস বিভাগ, ২০১৮-১৯ সেশন) এর কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, ‘চল মোশারেফ ভাই এর কাছে মাফ চাবি।’ এরপর আমাকে ওই জায়গা থেকে টেনে নিয়ে আসা হয় গেস্ট রুমে, সেখানে অজ্ঞাতনামা আরো ৭/৮ জন ছিলো। সেখানে আমাকে আরো ২০ মিনিট-এর কাছাকাছি সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে মানসিক হেনস্তা করা হয় এবং আমাকে খালি গায়ে ভিডিও করাসহ বাঁচার শর্তে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।
আরও পড়ুন: ‘ব্রিটিশ-পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয়েছি, কিন্তু প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়তে পারিনি’
ফয়সাল বাদশা বলেন, ‘ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী সন্ত্রাসী কায়দায় আমাকে গভীররাতে হলের রুম থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে এসে যেভাবে শারীরিক হেনস্তা ও মানসিক নির্যাতন করেছে তাতে আমি আমার জীবন নিয়ে শঙ্কিত এবং এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারিনি। হলে থেকে আমি আমার পরবর্তী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কিনা তা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছি। আমার জীবনের নিরাপত্তা প্রদান এবং ছাত্রদল কর্তৃক আমার ওপরে হওয়া নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।’
অপর শিক্ষার্থী এস. এম. ওয়াহিদুর রহমানের অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করেন, তাকে হলের মূল ফটকের সামনে নিয়ে ছাত্রদলের নবনির্বাচিত সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান, আহসান উল্লাহ্, আকিবুর রহমান, সোহানুর রহমান সিফাত, রবিন মিয়াসহ কয়েকজন অজ্ঞাতনামা নেতাকর্মী ঘিরে ধরেন। তার দেহ তল্লাশি করা হয় এবং হলে বৈধভাবে থাকার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তাকে ‘ছাত্রলীগ ট্যাগ’ দিয়ে আওয়ামী লীগের আমলে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে হলে থাকার অভিযোগ আনা হয়। পূর্বের একটি ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে রবিন মিয়া তাকে হত্যার হুমকি দেন এবং ভবিষ্যতে "বাঁচতে দেওয়া হবে না" বলে ভয় দেখান। এ সময় তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ এবং সংঘবদ্ধভাবে মানসিকভাবে হেয় করা হয়।
উভয় শিক্ষার্থী উল্লেখ করেন, চারুকলা সংসদ আয়োজিত ‘মাঘমল্লার’ অনুষ্ঠানে গভীর রাত পর্যন্ত শব্দদূষণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের ক্ষোভের দায় তাদের ওপর চাপানো হয়। তাদের হুমকি দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে ছাত্রদলের নির্দেশ না মানলে ‘চরম পরিণতি’ ভোগ করতে হবে।
ভুক্তভোগীরা জানান, এই ঘটনার পর তারা চরম আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং হলে স্বাভাবিকভাবে বসবাস ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। তারা দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
প্রতিবেদনটি লেখার সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম লিখেন, ‘আজ সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের সামনে ছাত্রদলের সভাপতি মোশাররফ ভাই এর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলি। কথার মাঝখানে, হঠাৎ করে ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী ছাত্রদল নিয়ে পোস্ট দেওয়ার জন্যে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথা বলে। আমি প্রতিবাদ করলে তারা আমাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে। আমি আবারও প্রতিবাদ করলে, পরবর্তীতে ছাত্রদল নিয়ে পোস্ট করলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়।’
রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে গত ৬ ডিসেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন হয়। তারপর থেকে এই ১০ দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা এই ছাত্রদলটি নানান বিতর্ক জন্ম দিচ্ছে। যা সংগঠনটির কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে শাখা ছাত্রদল নেতাকর্মীদের দাবি, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গুজব ছড়াচ্ছে কিছু কুচক্রী মহল।
উল্লিখিত ঘটনাটি অস্বীকার করে অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতাকর্মী সোহানুর রহমান সিফাত বলেন, ‘এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনার তো কোনো প্রাসঙ্গিকতা নাই। হল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছে কিন্তু তারাও তো আমাদের এখনো কিছু জানাননি।’
বি ছাত্রদল সভাপতি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি তোমার কাছেই প্রথম শুনলাম। এমন কোনো ঘটনার কথা জানি না। আমি কিংবা মিজান কেউ সেখানে ছিলাম না। তবে ছাত্রদলের অন্য কেউ ছিল কিনা সেটা জানি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রাহাত হোসেন ফয়সাল (ভারপ্রাপ্ত) বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি শুনেছি। ঘটনার সত্যতা পেলে প্রশাসন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে।’