১৯ আগস্ট ২০২৫, ১৭:২১

সমন্বয়কদের সঙ্গে বেরোবি প্রশাসনের টানাপোড়েনে ‘বলির পাঁঠা’ ছাত্রসংসদ নির্বাচন?

অনশনরত শিক্ষার্থীরা  © টিডিসি ফটো

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে চলমান অনশন নিয়ে বিভাজন দেখা দিয়েছে। অনশনে ছাত্রদল-শিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রকাশ্য সংহতি ও বহিরাগত সমন্বয়কারীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের অভিযোগ, এ অনশন এখন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তাই অচলাবস্থা ও অস্থিরতা এড়াতে দ্রুত অনশন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা।

জানা যায়, গত ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের উত্তর গেটে নয়জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেন। পরবর্তীতে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী খোকন যোগ দিলেও এ পর্যন্ত কয়েকজন শিক্ষার্থী অনশন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। অনশনের প্রাথমিক তালিকায় ছিলেন ইইই বিভাগের আশিকুর রহমান আশিক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জাহিদ হাসান জয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাহিদ ইসলাম, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ের কায়সার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের নয়ন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের রাজ, অর্থনীতি বিভাগের আতিকুর, গণিত বিভাগের আরমান ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিবলি সাদিক।

এদিকে শুরু থেকেই অনশনকারীদের মধ্যে বিভাজন ছিলো তিনভাগে। একাংশকে নেতৃত্ব দেন সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী রহমত আলী ও তার অনুসারীরা, অপর অংশে আছেন সাবেক সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমনসহ অন্যান্যরা । বাকি অংশে কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী। তবে ইতিমধ্যেই শিবলি সাদিক ও মুশফিকুর রহমান শুভ অনশন প্রত্যাহার করেছেন।

আরও পড়ুন: পাস করেও একাদশে ভর্তির আবেদন করেনি লাখের বেশি শিক্ষার্থী

অপরদিকে ১৯ আগস্ট ইউজিসির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বেরোবির ছাত্র সংসদ নির্বাচন আইন যাচাই ও চূড়ান্তকরণের জন্য গঠিত কমিটির প্রথম বৈঠক হবে ২১ আগস্ট।

অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ না থাকায় নবাগতদের জোরপূর্বক ডেকে আনা হয় অনশনে সংহতি জানাতে। এছাড়া অনশন ঘিরে বহিরাগতদের আনাগোনায় ক্যাম্পাসে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একাউন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, ‘সমন্বয়করা শিক্ষার্থীদের মতামত ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়। অতীতে মামলা বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে।’

সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দশদিন সময় চেয়েছেন। আর আইন তৈরিতে তো সময় লাগবে। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নেই, ইউজিসি সহ অন্যান্য সংস্থার কাজ এটা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়কে এমন অস্থীতিশীল করার কারণ কী? ঘোষণার পরও যারা অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা মূলত গোপন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন। তাই ষড়যন্ত্র এড়াতে অনশন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে বলে দাবি তাদের।

পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তুহিন রানা জানান, ‘ছাত্র সংসদ আমাদের যৌক্তিক দাবি। কিন্তু উপাচার্য যখন আইন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তির জন্য ১০ দিন সময় চেয়েছেন, তখনও অনশন চালিয়ে যাওয়া অযৌক্তিক। এতে ষড়যন্ত্রের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’

‘আমি আতিকুর রহমান, বেরোবি ছাত্র সংসদ এর দাবিতে শুরু থেকে আমরণ অনশনে থাকা ৯ জন শিক্ষার্থীর একজন। ভিসি স্যারের ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে আইন প্রণয়নের কমিটমেন্ট এবং ইউজিসির এই সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি দেখে আশ্বস্ত হয়ে আমি অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছি। যারা আমার অসুস্থতায় পাশে ছিলেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার শারীরিক সুস্থতার জন্য সকলের কাছে দোয়া চাচ্ছি।’

অনশনকারী শিক্ষার্থী শিবলি সাদিক বলেন, ‘আমরা অনশন শুরু করেছিলাম ছাত্র সংসদের দাবিতে। কিন্তু দেখি আন্দোলনে নানা পক্ষ জড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য উপাচার্যের সময় প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমরা অনশন প্রত্যাহার করি। কিন্তু আমাদের দাবি আদায়ের পক্ষে অনড় রয়েছি। দশদিনেও কোন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিবো।

আরও পড়ুন: সুপারিশ পেলেন ৪১৬২৭ জন, নিয়োগপত্র ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে

অনশনে অংশ নেওয়া অর্থনীতি ১৬ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান আজ বিকেলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনশন থেকে সরে গেছেন। তিনি বলেন, ‘বেরোবি ছাত্র সংসদ এর দাবিতে শুরু থেকে আমরণ অনশনে থাকা ৯ জন শিক্ষার্থীর একজন। ভিসি স্যারের ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে আইন প্রণয়নের কমিটমেন্ট এবং ইউজিসির এই সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি দেখে আশ্বস্ত হয়ে আমি অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছি। যারা আমার অসুস্থতায় পাশে ছিলেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার শারীরিক সুস্থতার জন্য সকলের কাছে দোয়া চাচ্ছি।’

এদিকে ছাত্র সংসদের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছে। আন্দোলনের একাংশ অনশন থেকে সরে এলেও সাবেক ছাত্রলীগের কিছু সদস্য ও স্বঘোষিত সমন্বয়কগণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে আন্দোলনের স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক সংশয় ও বিভ্রান্তি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত কয়েক মাস ধরেই প্রশাসন ও সমন্বয়ক নামধারী কিছু ব্যক্তির মধ্যে মতবিরোধ চরমে পৌঁছেছে। এসব সমন্বয়ক পূর্বে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন নিজেদের নির্দলীয় ও ছাত্রবান্ধব পরিচয়ে উপস্থাপন করছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে প্রভাব বিস্তার, নিয়োগ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রাধান্য পাওয়া নিয়ে অভিযোগ থাকায় সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়।

বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সমন্বয়করা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার কার্যালয়ে শাড়ি ও চুড়ি রেখে যান, যা সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার জন্ম দেয় এবং ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। এ ঘটনার পর থেকেই প্রশাসনের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। সেই সাথে শাড়ি চুড়ির বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরাও। 

গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে এ সমন্বয়কদের আর দেখা যায়নি, যেখানে তারা আগে নিয়মিত মুখ ছিলেন। অনেকেই বলছেন, এই অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়াতেই তারা হঠাৎ করে ছাত্র সংসদ ইস্যুকে সামনে এনে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, যাতে প্রশাসনকে চাপে ফেলা যায়।

প্রথমদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে সামান্য সাড়া দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ইউজিসির মিটিংয়ের চিঠি, প্রশাসনের কমিটমেন্ট সবকিছু উপেক্ষা করার কারণ কী হতে পারে? প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের। তারা বলছেন, আন্দোলনের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য। এর ফলে অনেকেই এখন সমন্বয়কদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।

এরই মধ্যে কয়েকজন অনশন থেকে সরে এসেছেন। তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশাসনের দেওয়া দশ কর্মদিবসের মধ্যে নির্দষ্ট রোডম্যাপ না আসলে তারা কঠোর কর্মসূচি চালাবেন বলে জানিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক ছাত্রলীগের কিছু নেতা 'সমন্বয়ক' নাম ধারণ করে প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক সুবিধা আদায় করেন। এখন প্রশাসনের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ভাটা পড়তেই তারা হঠাৎ করে ছাত্র সংসদের প্রশ্নে সরব হয়েছেন।

আরও পড়ুন: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতের তথ্য প্রেরণের আহ্বান মাউশির 

‘সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাথে যাদের সখ্যতা তারাই এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ থেকে সমন্বয়ক, এখন সমন্বয়ক শব্দটি বাজারে চলে না, তাই হয়ত তারা ছাত্রসংসদ ইস্যু এনে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। চাওয়াটা যৌক্তিক, কিন্তু চাওয়ার রাস্তাটা অযৌক্তিক।’-বাংলা বিভাগের নাসির উদ্দিন

বিশ্ববিদ্যালয়টির সিএসই বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাজমুন বলেন, ‘একটা আইন তৈরি করা সাধারণ বিষয় নয়। এটির জন্য যে সময় প্রয়োজন সেটি দিতে হবে। ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটি বাস্তবায়নের তো সময় দিতে হবে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এমন অবুঝের মত আচরণ কাম্য নয়।’

আরেকজন শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগের নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাথে যাদের সখ্যতা তারাই এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ থেকে সমন্বয়ক, এখন সমন্বয়ক শব্দটি বাজারে চলে না, তাই হয়ত তারা ছাত্রসংসদ ইস্যু এনে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। চাওয়াটা যৌক্তিক, কিন্তু চাওয়ার রাস্তাটা অযৌক্তিক।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র বলছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য দশ দিনের সময় চেয়েছেন ছাত্র সংসদ বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করতে। তার এই আশ্বাসে আন্দোলনের একটি অংশ অনশন থেকে সরে এলেও সমন্বয়করা তা মানতে রাজি নন এবং অনশন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। এতে প্রশ্ন উঠেছে আসলেই কি তাদের লক্ষ্য ছাত্র সংসদ, নাকি প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে আবারও প্রভাব বিস্তার? উপাচার্য একাধিকবার তাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করলেও তারা অনশন ভাঙাতে নারাজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘আন্দোলনরতদের স্বাগত, কিন্তু আন্দোলনের পেছনে যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হুমকিস্বরূপ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।’

এ বিষয়ে প্রক্টর ড. ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে কোনো দাবি উত্থাপন করতে পারে, এটি সাংবিধানিক অধিকার। তবে ছাত্র সংসদ নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির পথে। উপাচার্য ১০ কর্মদিবস সময় চেয়েছেন। তাই অনশন না করে প্রতিশ্রুতিকে মেনে নেওয়াই উচিত।’