জোবেদার ‘ডাক না পাওয়া নিয়োগে’ শিক্ষক হলেন ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষক নিয়োগে ‘জালিয়াতির আশ্রয়’ নিয়ে নিয়োগ প্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তিনি এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিও ‘খেয়ে দেওয়া’র হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলাম। এছাড়াও একটি পদের বিপরীতে একজন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষককে ছুটিতে পাঠিয়ে সৃষ্টি করা হয় নতুন পদ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়েছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নিয়ম অনুযায়ী, নিয়োগ পরীক্ষার আগে সব প্রার্থীদের ডাকযোগ, ই-মেইল বা ক্ষুদে বার্তায় পরীক্ষার সময়, স্থান ও সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে অবগত করার কথা প্রার্থীদের। এছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তাদের প্রবেশপত্রও সরবরাহ করার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা পরীক্ষা আয়োজক কমিটি এ কাজটি করে থাকেন। কিন্তু বেরোবিতে তার কিছুই করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি পদের বিপরীতে একজন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সোহাগ আলীকে শিক্ষা ছুটিতে পাঠিয়ে নতুন করে শূন্য পদ দেখিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলামকে। এর আগে এ পদে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ পান একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামী আক্তার।
এ ঘটনায় বিচার চাওয়ার পর ভুক্তভোগী আমার স্ত্রীর বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ‘খেয়ে দেওয়া’র হুমকি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী ও সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক মো. মনিরুল ইসলাম—রাসেদুল ইসলাম রাশেদ, ভুক্তভোগী জোবেদার স্বামী।
এছাড়াও ২১ সেপ্টেম্বর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সকল প্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য জানানোর কথা থাকলেও জানানো হয়নি স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম অবস্থানে থাকা ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জোবেদা আক্তারকে।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোবেদাকে কল করে জানানো হয়েছে বলে যে দাবি এবং কল লিস্ট প্রকাশ করা হয়েছে—তারও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ওই শিক্ষার্থীর ফোন নম্বরের বিগত কলগুলোর রেকর্ড ও গ্রামীণফোন সেন্টার হতে প্রাপ্ত কল লিস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কল প্রাপ্তির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী, চিঠি বা ই-মেইল এবং পরবর্তীতে কল কিংবা ক্ষুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে প্রার্থীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। যার কোনো তোয়াক্কাই করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
পরিকল্পিতভাবে ভুক্তভোগী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী জোবেদা আক্তারকে পরীক্ষা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ভুক্তভোগী জোবেদার স্বামী রাসেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন, এ ঘটনায় বিচার চাওয়ার পর ভুক্তভোগী জোবেদা আক্তারের বর্তমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ‘খেয়ে দেওয়া’র হুমকি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক মো. মনিরুল ইসলাম।
এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মোট ৪৭ জন নিয়োগ প্রত্যাশী। যেখানে পাস করেন মোট ৭ জন প্রার্থী। তবে ভুক্তভোগী নারী শিক্ষার্থী জোবেদা আক্তার যেহেতু পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তাই তার কোনো ফলাফলও আসেনি।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের ঠিকানায় গত আগস্ট মাসেই পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে প্রার্থীদের দেওয়া মোবাইল নম্বরে এসএমএস ও কল করা হয়েছে—মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উপ-রেজিস্টার, সংস্থাপন শাখা, বেরোবি।
অদম্য ও মেধাবী এই শিক্ষার্থীর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ এর পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাস্তরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছিলেন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী এবং সিজিপিএ ছিল যথাক্রমে ৩.৬২ ও ৩.৫৫। এছাড়াও শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ হওয়ার স্বপ্ন বোনা এই তরুণ শিক্ষার্থী পেয়েছেন উচ্চশিক্ষায় কৃতিত্বের সর্বোচ্চ সম্মান প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদকও।
আরও পড়ুন: অনার্স-মাস্টার্সে ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’, শিক্ষক নিয়োগে ডাক পেলেন না জোবেদা
বিপরীতে নিয়ম ভঙ্গ করে সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলামকে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহাগ আলীকে শিক্ষা ছুটিতে পাঠানো হয় গত ১২ সেপ্টেম্বর এবং এরপর ২০ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা বোর্ড ডাকা হয়। অর্থাৎ বিভাগের একজন শিক্ষককে ছুটিতে পাঠিয়ে সৃষ্টি করা হয় শূণ্য পদ এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত হিসেবে নিয়োগ পান মো. মনিরুল ইসলাম। যা এখনও পাশ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে। এছাড়াও ফলাফলেও পিছিয়ে রয়েছেন মো. মনিরুল ইসলাম; স্নাতকে তার মোট সিজিপিএ ৩ দশমিক ২৬।
এ নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জোবেদা জানিয়েছেন, স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করি। কিন্তু গত ২১ সেপ্টেম্বর সেই নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নিয়োগ সম্পন্ন করা হলেও আমাকে কোনো চিঠি, মেসেজ বা মোবাইল কল করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, আমাকে মেসেজ ও কল করা হয়েছিল। কিন্তু আমি মোবাইল বার বার চেক করেছি। গ্রামীণফোন অফিস থেকে এক মাসের কল ও মেসেজ লিস্টও বের করে দেখেছি। সেপ্টেম্বর মাসের ১ থেকে ২৫ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো কল বা মেসেজ আসেনি।
এ নিয়ে সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মো. মনিরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি গত মাসের ২৫ তারিখ চাকরিতে জয়েন করেছেন। জোবেদা আক্তার বা কাউকে তিনি হুমকি দেননি। এটি ভিত্তিহীন এবং তিনি বর্তমানে তার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন; এর বেশি তিনি কোনো কিছু বলতে পারবেন না।
গত ২১ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নিয়োগ সম্পন্ন করা হলেও আমাকে কোনো চিঠি, মেসেজ বা মোবাইল কল করা হয়নি। আমি মোবাইল বার বার চেক করেছি। গ্রামীণফোন অফিস থেকে এক মাসের কল ও মেসেজ লিস্টও বের করে দেখেছি। সেপ্টেম্বর মাসের ১ থেকে ২৫ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো কল বা মেসেজ আসেনি—জোবেদা আক্তার, ভুক্তভোগী নিয়োগ প্রত্যাশী।
অন্যদিকে ‘চাকরি খেয়ে দেওয়ার হুমকি’ এবং জোবেদা আক্তারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলামের কাছে। শুরুতে তিনি জোবেদা আক্তারের আন্দোলন এবং তাকে (জোবেদা) প্রক্টর অফিসে ডেকে নিয়ে তার (জোবেদা) আন্দোলনের বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়েছে বলে জানালেও তিনি তা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। এছাড়াও একই বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি ওই শিক্ষার্থীকে হুমকি দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গোলাম রব্বানীর।
এরপর তিনি সরাসরি প্রতিবেদকের সাথে দেখা না করে মোবাইল ফোনে কোনো বক্তব্য দেবেন না বলে জানান। তবে আলাপনের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। প্রতিবেদকের মাধ্যমে সবেমাত্র জ্ঞাত হয়েছেন এবং এ নিয়ে তিনি প্রতিবেদকের সাথে সরাসরি কথা হলে মন্তব্য প্রদান করবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা ও আইসিটি সেলে যোগাযোগ করা হলে কল ও ক্ষুদে বার্তা না দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তারা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত চিঠি জোবেদা আক্তারের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। তার দেওয়া মোবাইল নম্বরে মেসেজ ও কল করা হয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
পরীক্ষার আগে ওই (জোবেদা) শিক্ষার্থীকে জানানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত কল রেকর্ডসহ যাবতীয় রেকর্ড তাঁদের কাছে রয়েছে। আর আন্দোলন এবং অভিযোগের বিষয়ে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে জবাব দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জোবেদাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।—উপাচার্য
যদিও বেরোবি সংস্থাপন শাখার উপ-রেজিস্টার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের ঠিকানায় গত আগস্ট মাসেই পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে প্রার্থীদের দেওয়া মোবাইল নম্বরে এসএমএস ও কল করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগকারী প্রার্থীর দেওয়া নম্বরেও অন্যান্য প্রার্থীর মতোই একাধিকবার কল করা হয়েছে তিনি রিসিভ করেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ জানিয়েছেন, পরীক্ষার আগে ওই শিক্ষার্থীকে জানানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত কল রেকর্ডসহ যাবতীয় রেকর্ড তাঁদের কাছে রয়েছে। তবে তা তিনি এ মুহুর্তে দিতে পারবেন না বলে জানান। আর আন্দোলন এবং অভিযোগের বিষয়ে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে জবাব দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জোবেদাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে; জবাব পাওয়ার পর তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
একটি পদের একজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর দু’জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য ড. মো. হাসিবুর রশীদ বলেন, নিয়োগ কমিটির তাকে যোগ্য মনে হয়েছে; সেজন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি সিন্ডিকেট সভায় তোলা হবে। তারা পাস করলে এটি গ্রহণ করা হবে। আর ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সোহাগ আলীকে শিক্ষা ছুটিতে পাঠানো হয়নি। বরং তিনি নিজেই ছুটি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।