শ্রেণিকক্ষ সংকটে শিক্ষক লাউঞ্জে ক্লাস, প্রতিবাদে মুখোমুখি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
ক্লাসরুম সংকটের কারণে তীব্র সেশনজটের কবলে পড়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি সমাধানে প্রশাসনের নিকট দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় এবার বিভাগটির ভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে ক্লাস করছেন তারা।
শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টায় তারা সেখানে ক্লাস শুরু করেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এসময় ক্লাস চলাকালীন সময়ে শিক্ষক লাউঞ্জের সামনে অবস্থান নিয়ে এর প্রতিবাদ জানান ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম আব্দুর রহিম।
বিভাগের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দুই যুগেরও অধিক বয়সী এই বিভাগটিতে বর্তমানে ৬টি ব্যাচে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে এই ছয়টি ব্যাচের জন্য পাঠদানের জন্য ক্লাসরুম রয়েছে মাত্র দুইটি। ফলে ঠিকমতো ক্লাস নিতে পারছেন না শিক্ষকরা। এতে ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিভাগটির মাস্টার্স ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দুই বছরের জট রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া অনার্সের সবগুলো সেশনে ৬ থেকে আট মাসের সেশনজট রয়েছে। ক্লাস সংকট নিরসনে প্রশাসনের নিকট দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসলেও কোনোরূপ সমাধান না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে গত জুলাই মাসে ভবনের সেমিনার রুম (১৪০ নম্বর কক্ষ) এবং শিক্ষক লাউঞ্জের ভিতরে থাকা সোফাগুলো বের করে সেখানে টেবিল চেয়ার ঢুকিয়ে রুমগুলো দখলে নিয়ে তালা দিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এরপর উপাচার্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে তখন রুমগুলোর তালা খুলে দেন তারা। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখ অতিবাহিত হলেও কোনো সমাধান না হলে শিক্ষার্থীরা পুনরায় কক্ষগুলোতে তালা দেন। এবং আজ সকাল ১০টায় সেখানে ক্লাস করেন।
আরও পড়ুন: নিয়মের তোয়াক্কা না করে দেড় কোটি টাকায় কুবি ভিসির গাড়িবিলাস
এর আগে সকাল ৯টায় ইইই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম আব্দুর রহিম নাস্তা করার জন্য সেখানে গেলে ওইরুমে তালা দেয়া দেখতে পান এবং বিষয়টি জানতে পারেন। এর প্রতিবাদে সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তিনি। পাঁচ ঘন্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন শেষে শিক্ষক সমিতির সভাপতির আশ্বাসে তিনি তার অবস্থান ত্যাগ করেন। লাউঞ্জটি ফেরত দেওয়া না হলে পরবর্তীতে তিনি পুনরায় আবার অবস্থান নিবেন বলে জানান।
এস এম আব্দুর রহিম বলেন, ‘সকালে গিয়ে দেখি শিক্ষক লাউঞ্জে তালা দেওয়া। রাতের আধারে হোক আর যেভাবেই দখল করা হোক, শিক্ষক লাউঞ্জ একটা বিভাগ দখল করে নিবে কেন? এটা যেহেতু শিক্ষক সংশ্লিষ্ট ব্যাপার, তাই এটা আমার আত্মসম্মানে লেগেছে বিধায় আমি সেখানে অবস্থান নিয়েছি। শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের আশ্বাসে আমি অবস্থান কর্মসূচি আপাতত বন্ধ করেছি। কিন্তু এটি যদি উদ্ধার না, তাহলে আমি আবার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।’
এদিকে ক্লাস চলাকালীন সময়ে তিনি সেখানে বসে লাগাতার ধুমপান করছিলেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করেছেন বলেও তাদের অভিযোগ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা সকালে ক্লাস করতে গিয়ে দেখি ওখানে একজন শিক্ষক দরজার সামনে একটি টেবিলে একটি সিগারেটের বাক্স এবং কলা নিয়ে বসে আছেন। তিনি সেখানে বসে লাগাতার ধুমপান করেই যাচ্ছিলেন। একজন শিক্ষক হয়ে তিনি কীভাবে এমন অনৈতিক কাজ করতে পারেন। একজন অধ্যাপক ক্লাস নিচ্ছেন আর এক শিক্ষক সেখানে বসে পায়ের উপর পা তুলে বিড়ি খাচ্ছেন। এর মাধ্যমে তিনি কি মেসেজ দিচ্ছেন? তিনি কোন সংস্কৃতির জানান দিতে চান?’
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন প্রক্টর অধ্যপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ
এদিকে দুপুর ২টায় বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদের সাথে মধ্যস্থততাকারী হিসেবে প্রক্টরিয়াল বডি শিক্ষক লাউঞ্জে সামনে উপস্থিত হন। এসময় তারা কোনোরকম সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে হাতুড়ি দিয়ে কক্ষের তালা ভাঙার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদেরকে বাঁধা দেন। এসময় প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ তালা খুলে না দিলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে প্রক্টরিয়াল বডি সেখান থেকে চলে যান।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছি অথচ তারা (প্রক্টরিয়াল বডি) আমাদের বলছে আমরা নাকি মাস্তানি করতে আসছি। প্রক্টর হিসেবে তিনি এখানে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে প্রশাসনের সাথে কথা বলে বিষয়টি সমাধান না করে উল্টো হাতুড়ি শাবল নিয়ে এখানে এসেছেন তালা ভাঙতে। আমাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিপরীতে তারাই আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছেন।’
তারা আরও বলেন, ‘আমাদের দাবি ছিল আমাদের ক্লাসরুম ব্যবস্থা করলে আমরা এখনই শিক্ষক লাউঞ্জ ছেড়ে দিব। শিক্ষকদের লাউঞ্জ রুম না থাকলে শিক্ষকেদর কিছুই হবে না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম না থাকলে মাসের পর মাস জটে থাকতে হবে। ইতোমধ্যে ক্লাসরুম সংকটের কারনে আমরা প্রত্যেকটি ব্যাচ জটে আছি।’
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শুদ্ধাচার কর্মশালার নামে ডিনার পার্টির আয়োজন
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন আজাদ বলেন, ‘তাদের এই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। প্রশাসনের নির্দেশে আমরা সেখানে যাই। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে আমরা সেখান থেকে ফিরে আসি।’
এদিকে ক্লাস সংকটের বিষয়ে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. শরিফ মো. আল-রেজা বলেন, 'সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে আমরা এক সময় সেশনজট মুক্ত বিভাগ ছিলাম। রিসোর্সের দিক থেকে আমাদের শিক্ষকরা অনেক এগিয়ে। শিক্ষার্থীরা আমাদের বিভাগে আসবে আর ক্লাস হবে না এই কালচার আমাদের নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২২-২৩ সেশন ভর্তি হওয়ার ফলে ৬ টা সেশন রানিং রয়েছে। ৬ টা সেশনের জন্য দুইটা ক্লাস রুম থাকায় রুম সংকটে ভুগছে শিক্ষার্থীরা। আমরা প্রশাসনকে কয়েকবার জানিয়েছি। পরে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভিসি স্যারের সাথে দেখা করেন। তিনি তাদের আশ্বস্ত করলেও এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা হয়তো ওই রুমে তালা দিয়েছে। আমি এটা পরে শুনেছি। আশা করি সংকটের বিষয়ে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'এটা সমাধান করার জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সম্পাদক, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির তিনজন ডিন নিয়ে এ কমিটি করা হয়েছে। তারা এখনো আমাদের রিপোর্ট দেয়নি। রিপোর্ট দিলে আশা করি সমস্যাটির সমাধান হয়ে যাবে।’