২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন সরকারের
- ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া
- প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ০৯:১২ PM , আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩, ০৯:৫৮ PM
দুই অর্থবছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ও ২৫ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যয়ের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ অডিট প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থেকে প্রকাশিত এক অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউজিসি ও ২৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাবের ওপর নিরীক্ষা করেছে।
২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেখ হাসিনা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বোচ্চ অঙ্কের আপত্তি জানানো হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে মোট ২০টি খাতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩৫টি খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আপত্তি জানানো হয়েছে (একক আপত্তি ১৭৪ কোটি ২৬ লাখ)।
নিরীক্ষায় ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট ১৮৭ ধরনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি জানানো হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪১৯ কোটি ৬২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬৭ টাকা। আপত্তি জানানো ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান মনিটরিং ফি’র নামে ইউজিসি কর্তৃক কর্তন, সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করা, বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষকদেরকে প্রাপ্যতা অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা, ইউজিসি'র অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বিধি বহির্ভূতভাবে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ, সিসিজিপি অনুমোদন ব্যতীত আর্থিক ক্রয়সীমার অতিরিক্ত অনিয়মিতভাবে কার্যাদেশ প্রদান।
আপত্তিতে আরও রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন বিল হতে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন না করা, সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অর্থ বিধি বহির্ভূতভাবে অন্য ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর, মন্ত্রী পরিষদ কমিটির অনুমোদন এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতীত পূর্ত কাজের বিপরীতে চুক্তি, অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানপূর্বক দায়িত্ব ভাতা প্রদান, সরকারের পূর্বানোমোদন এবং ডিপিপি, আরডিপি ব্যতীত পূর্তকাজের বিপরীতে চুক্তি সম্পাদন, বিডিরেন কর্তৃক প্রদত্ত ইন্টারনেট সেবার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সরকারের অনুদান মঞ্জুরী হতে ইউজিসি কর্তৃক অনিয়মিতভাবে কর্তন ইত্যাদি।
এদের মধ্যে সর্বোচ্চ অঙ্কের আপত্তি জানানো হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে মোট ২০টি খাতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৩৫টি খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আপত্তি জানানো হয়েছে (একক আপত্তি ১৭৪ কোটি ২৬ লাখ)।
এ বিষয়গুলো আমাদের অর্থ দপ্তর দেখে। আমি বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নই, এ বিষয়ে খোঁজ নেব- অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১১৪ কোটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১১৩ কোটি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৬৩ কোটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসকে প্রায় ১১ কোটি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১০ কোটি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১০ কোটি, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৮ কোটি ৪৩ লাখ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৩ কোটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ২ কোটি ৬৭ লাখ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ২ কোটি, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ, শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৩২ লাখ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ৮ লাখ এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার টাকার একক আপত্তি জানানো হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সমন্বিতভাবে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে প্রায় ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি জানানো হয়েছে।
এদের মধ্যে একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ আপত্তি ১৭৩ কোটি ১০ লক্ষ ১৪ হাজার ৩৮৮ টাকার। সিসিজিপি অনুমোদন ব্যতীত আর্থিক ক্রয়সীমার অতিরিক্ত কার্যাদেশ প্রদান করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ আপত্তি জানানো হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৫০ কোটি টাকার উপরে যেকোনো ক্রয়প্রস্তাবের চুক্তি মন্ত্রীপরিষদ অনুমোদিত হতে হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ (১ম সংশোধন) প্রকল্পের অধীনে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ এবং আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজের জন্য মন্ত্রীপরিষদের অনুমোদন ব্যতীত ভিসির অনুমোদনে চুক্তি করা হয়। এ বিষয়ে অডিট আপত্তি গ্রহণ করা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেয়া হয়নি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকভাবে এই আপত্তির জবাব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই বিষয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় মিটিং হয়ে আপত্তির বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করি এরপর আর এই আপত্তি থাকবে না, এটি কেটে যাবে।- মো. সাজেদুল হক, পরিচালক, ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আপত্তি ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৩ টাকার। সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ আপত্তি জানানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে উল্লেখিত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ আপত্তি ১৬০ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৮ টাকার। সরকারের পূর্বানুমোদন এবং ডিপিপি/আরডিপিপি প্রণয়ণ ব্যতীত অনিয়মিতভাবে পূর্তকাজের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে এ আপত্তি জানানো হয়।
অডিট আপত্তির বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ শামসুল আরেফিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অডিট আপত্তি একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রতিবছরই সিএজি কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানায়। তারপর আমরা জবাব দিয়ে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করি। এটা এমন নয় যে এবারই প্রথম। এরকম প্রতি বছরেই হয়ে থাকে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় না; বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ মন্ত্রণালয়েও অডিট আপত্তি হয়ে থাকে। আপত্তি উঠেছে বলেই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস বিভাগের পরিচালক মো. সাজেদুল হক বলেন, শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই অর্থ বছরের ব্যয়ের উপর অডিট আপত্তি দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকভাবে এই আপত্তির জবাব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই বিষয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বি-পক্ষীয় মিটিং হয়ে আপত্তির বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করি এরপর আর এই আপত্তি থাকবে না, কেটে যাবে।
এই আপত্তির কোন ভিত্তি নাই উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে তারা আপত্তি দিয়েছে। এটার জন্যও নাকি আমাদের অনুমোদন নিতে হবে। এই মাস্টারপ্ল্যানে রয়েছে সিনেট ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবন এবং আইসিটি ভবন। এগুলোর ব্যাপারে বড়জোর আমরা সরকারকে অবহিত করতে পারি; কিন্তু এটার জন্য সরকারের কোন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে আমি এই আপত্তির কোন যৌক্তিকতা দেখিনা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ বিষয়গুলো আমাদের অর্থ দপ্তর দেখে। আমি বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নই, এ বিষয়ে খোঁজ নেব।
এ বিষয়ে নিরীক্ষা দলের প্রধান শাকিলা জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিরীক্ষা শেষে সুপারিশ জানিয়েছে। এখন পরবর্তী বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেমন সংসদীয় কমিটি আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে।