দুই মাস যেতে না যেতে ঘুণে ধরা আসবাবপত্রের প্রশংসায় কুবি ভিসি
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত শেখ হাসিনা হলের জন্য আসবাবপত্র সরবরাহের দুই মাসের মাথায় এতে ঘুণে ধরেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুুল মঈন এ ‘ঘুণে ধরা’ এ আসবাবপত্রগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সেরা মানসম্পন্ন আসবাবপত্র বলে দাবি করেছেন। তবে হলটির আবাসিক ছাত্রীরা বলছেন, ঘুণে ধরার পর তাদের জিনিসপত্র ময়লা হয়ে গেছে। এতে তারা ভোগান্তিতে রয়েছেন।
তবে অধ্যাপক আবদুুল মঈনের দাবি যাচাই বাছাই কমিটি আগেই ফ্যাক্টরিতে গিয়ে আসবাবপত্রগুলো দেখেছেন। এই আসবাবপত্রের কোয়ালিটি ভেরি হাই ও বেস্ট কোয়ালিটি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন ফার্নিচার আগে আসেনি।
চলতি বছরের ৩১ জুলাই আসবাবপত্র ছাড়াই শেখ হাসিনা হল নামে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিতীয় হল উদ্বোধন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হল উদ্বোধনের আগে এ হলসহ আর কয়েকটি ভবনের জন্য ৭১ লাখ ৭৫০ টাকার প্রকল্পের চুক্তির আওতায় মেসার্স আবু জাহের মৃধা নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসবাবপত্র সরবরাহ করতে থাকে।
তবে তাদের আসবাবপত্রের মান ভালো না হওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া শর্ত পূরণ না করার অভিযোগে তাদের সাথে চুক্তি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। এরপর ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফআইডিসি) ইষ্টার্ণ উড ওয়ার্কসকে ১ কোটি ১০ লাখ ৮ হাজার ৭৭ টাকায় একই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়।
কার্যাদেশ অনুযায়ী ১৯ আগস্ট থেকে হলে আসবাবপত্র সরবরাহ করতে থাকে তারা। তবে আসবাবপত্র সরবরাহের দু’মাস না যেতেই মানহীন আসবাবপত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ‘রাবার কাঠ বিভিন্ন ধরনের হয়। এখানে হয়তো ভালো মানের রাবার কাঠ দেওয়া হয়নি বা অন্য কোনো ক্রুটি ছিল।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের আবাসিক হলের ভুক্তভোগী ছাত্রী জান্নাত জানান, এ হল নিয়ে শুরু থেকেই আমাদের অনেক বেশি আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। হল উদ্বোধনের পর আমাদের জন্য আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এসব আসবাবপত্রের দুই মাস যেতে না যেতেই ঘুনে ধরা শুরু হয়েছে। এতে হলের শিক্ষার্থীরা আশাহত হয়েছেন। এসব আসবাবপত্র ব্যবহারে আমরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এটা আমাদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
এদিকে, প্রথম দরপত্রে ৭১ লাখ ৭৫০ টাকা ব্যয়ে আকাশি কাঠের আসবাবপত্র সরবারহের জন্য কার্যাদেশ দিলেও পরবর্তী দরপত্রে দেড় গুণ বেশি ব্যয়ে রাবার কাঠের আসবাবপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয় কর্তৃপক্ষ।
তবে কাঠের আসবাবপত্র বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আকাশি কাঠের চেয়ে রাবার কাঠের মূল্য কয়েকগুণ কম। রাবার কাঠের পণ্যের আয়ুষ্কাল সাধারণত ৫-৬ বছর হয়। এ ধরনের কাঠের গুনাগুণ ভালো না হওয়ায় এ কাঠ অধিকাংশ সময় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।’
আরও পড়ুন: আবাসন সুবিধা নেই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ ভাগ শিক্ষার্থীর
প্রথম দরপত্রে হলের প্রতিটি খাটের মূল্য ১২ হাজার ৪৯৫ টাকা দর ধরা হলেও পরবর্তী দরপত্রে প্রতিটি খাটের দাম বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে চেয়ারের দর ৩ হাজার ৮৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার ৩৫ টাকা, ডাইনিং চেয়ার ১০ হাজার ৯৫০ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং লাইব্রেরি টেবিল ১০ হাজার ৮৩৫ থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে বিপরীতে রিডিং টেবিলের দাম ৮ হাজার ৯২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৮ হাজার ৮৮৫, ডাইনিং টেবিল ১৭ হাজার ৫০০ থেকে কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।
তবে ক্যাম্পাসের আশেপাশের আসবাবপত্রের দোকান মালিকরা দাবি করে তারা জানান, সরবরাহকৃত আসবাবপত্রগুলো মানসম্মত নয় এবং এসব কাঠের মূল্যও এত বেশি হওয়ার কথা নয়। এগুলো সর্বোচ্চ ৬ মাস টিকবে। এছাড়া রাবার কাঠ সকল আবহাওয়া উপযোগীও নয় বলে দাবি করেন তাঁরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা বলেন, কর্তৃপক্ষের লোকেদের অবৈধ যোগসাজশ না থাকলে দাম বাড়িয়ে নিম্নমানের আসবাবপত্র দিতে পারে না। স্পেসিফিকেশন কমিটির সুপারিশেরও ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এটি পুরোটাই কর্তৃপক্ষের সেচ্ছাচারিতার ফসল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ক্রয় কাজে দরপত্র আহ্বানের আগে পণ্যের চাহিদা ও বিবরণ তৈরি করে দেয় স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটি। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সেসকল পণ্যের জন্য দরপত্র আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। তবে স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আগের দরপত্রে আকাশি কাঠ দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের অজান্তেই পরবর্তী প্রতিষ্ঠানকে রাবার কাঠের আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য বলে কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: ভুল লোগোর ছড়াছড়ি
এ ব্যাপারে আসবাবপত্র স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. শামিমুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রশাসনকে আকাশি কাঠের আসবাবপত্র কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিয়েছিলাম। কমিটির সুপারিশকৃত আসবাবপত্র প্রশাসন কেন দেয়নি, সেটা তারা জানে।
এদিকে পূর্ববর্তী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বাতিল করলেও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাওনা মেটায়নি বলে অভিযোগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আজাদ উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছ থেকে ফার্নিচার না নিয়ে আমার বাজেট বাতিল করেছে। কিন্তু আমার ব্যয়কৃত টাকা তাঁরা দেয়নি। প্রশাসন আমার ৩৫ লাখ টাকা আটকে রেখেছে।
আসবাবপত্র সরবরাহের দু’মাসের মাথায় ঘুণে ধরার বিষয়ে আসবাবপত্র ক্রয় ও বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়েছে। যদি আসবাবপত্রে সমস্যা থাকে, তাহলে ওরা পরিবর্তন করে দিবে।
তবে আসবাবপত্র যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. জি এম মনিরুজ্জামান বলেন, শেখ হাসিনা হলের আসবাবপত্র যাচাই-বাছাই করার জন্য আমার কাছে কোনো চিঠি আসেনি। আমরা যাচাই-বাছাই করিনি। প্রশাসন কোন প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করেছে আমি জানি না।
বিএফএআইডিসির ইষ্টার্ণ উড ওয়ার্কসের ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, আসবাবপত্রগুলো রাবার কাঠের হলে নষ্ট হওয়ার কথা না। আমরাতো রাবার কাঠই দিয়েছি। এই কাঠ ৫০-১০০ বছরেও কিছু হওয়ার কথা না। তবুও আমরা আমাদের ট্রিটমেন্ট ইউনিটের কোন ক্রুটি হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে খোঁজ নেব। আর পর্যবেক্ষণের জন্য শিগগিরই টিম পাঠাব। ওরা কোনো সমস্যা দেখলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।