অবসরের বয়সে সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেন সুমনা

সুমনা সরকার
সুমনা সরকার  © সংগৃহীত

দীর্ঘ ১৮ বছর আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (সহকারী সার্জন) মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন সুমনা সরকার। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে বয়স ৫০ বছর হতে চলেছে তার। অবসরের বয়সে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) প্রথমবারের মতো সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।

অবশ্য মেয়ের এ দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শেষটা তার বাবা দেখে যেতে পারলেন না, তিনি মারা গেছেন ২০১৮ সালে। সুমনা সরকারের কাছে এটি তো শুধু চাকরি নয়, এ ছিল নিজের যোগ্যতা প্রমাণের পাশাপাশি বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অমল কৃষ্ণ সরকারের সম্মান রক্ষা করা। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা তো মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারেন না।

২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) নেওয়া ২৩তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাডারের প্রার্থী ছিলেন সুমনা। ওই বছরের মার্চে প্রিলিমিনারি এবং এপ্রিলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ২০০৩ সালের জুনে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। তবে তাঁর বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জটিলতার অভিযোগে চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা থেকে বাদ পড়েন তিনি।

আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ পেলেন সেই সুমনা

তারপর আইনি লড়াইয়ের ইতিহাসটা বেশ দীর্ঘ। সুমনা সরকার বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন ২০০৯ সালে। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলার রায় হয়। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল করে পিএসসি। আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দেন।

পরে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি হলে পিএসসিকে অসমাপ্ত মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। গত বছরের ১ জুন সুমনা সরকার পিএসসির চেয়ারম্যান বরাবর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন।

বছরটির ৩০ জুন পিএসসি সচিবালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) নুর আহমদের সই করা চিঠিতে সুমনাকে জানানো হয়, রায় বাস্তবায়নে সুমনার মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর অবশেষে অসমাপ্ত মৌখিক পরীক্ষা দেন সুমনা সরকার। ৭ অক্টোবর ফলাফল প্রকাশিত হয়। তারপর নানান প্রক্রিয়া শেষে তিনি চাকরিতে যোগ দিলেন।

সুমনা সরকার বলেন, পিএসসি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা এ ঘটনার জন্য কখনোই ক্ষমা চাননি। অথচ তাঁদের ভুলেই এতগুলো বছর লড়াই করতে হলো। নিয়োগের ক্ষেত্রে মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশনের রায়ের নির্দেশনা প্রতিপালনযোগ্য। তবে আমার নিয়োগে তা মানা হয়নি। নিয়োগকাল, চাকরির জ্যেষ্ঠতা ও ধারাবাহিকতা নির্ধারণে ২৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রথম যোগদান করা প্রার্থীদের মতোই হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সুমনা সরকার বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমার আইনজীবী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে রায়টা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার, তাই কেউ সেভাবে বলতে পারছেন না। সবাই পরামর্শ দিয়েছেন আগে চাকরিতে যোগ দিতে। তারপর সবার সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। আমার বন্ধুরা এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চিকিৎসক সুমনা সরকার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ২৩তম (মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য) বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সুমনা যে ছেলেকে পেটে নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই ছেলে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আরেক ছেলে কলেজে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেরা আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়। ছেলেদের বন্ধুদের কাছেও বিষয়টি গর্বের।’


সর্বশেষ সংবাদ