কমেছে আয়, করোনায় কাবু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের লোভনীয় একটি ব্যবসাখাত হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু মহামারি করোনা সব ওলটপালট করে দিয়েছে। কয়েকটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বেশিরভাগই অর্থসঙ্কটে পড়েছে। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাও নিয়মিত দিচ্ছে না। গত বছরের মার্চ মাস থেকে বন্ধ থাকায় অনেকগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে।
দেশের ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে তিন লাখ ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। আর শিক্ষক সংখা ১৬ হাজারের বেশি এবং ১৩ হাজারের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক খণ্ডকালীন শিক্ষককে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। চাকরি যায় যায় দশা কিছু স্থায়ী শিক্ষকেরও।
করোনায় অর্থসঙ্কটে পড়েছে বহু শিক্ষার্থীর পরিবার। এ কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি দিতে পারছেন না। ফলে একমাত্র অর্থের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
করোনাকালে দেশে দারিদ্রও বেড়েছে দ্বিগুণ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এ বছরের জানুয়ারিতে জানায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দেশের দারিদ্র ৪২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যেখানে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দেশের দারিদ্র ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ ছাড়া ২০২০ সালে পাস করা এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীরা এখনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন। সরকারির চেয়ে বেসরকারিতে পড়াশোনা ব্যয়বহুল। এজন্য শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশ বেসরকারিতে ভর্তির কথা এখনই ভাবছেন না।
অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশের (এপিইউবি) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসাইন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, অন্তত ৪০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার স্প্রিং সেমেস্টারে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
আরও পড়ুন: মানববন্ধনে বিষপানের চেষ্টা গুচ্ছে ভর্তিচ্ছু ছাত্রীর, থামাল পুলিশ
এমন দশায় পড়েছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। যেখানে গত বছর স্প্রিং সেমেস্টারে ( মে-আগস্ট) ৫০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল, এবার বিশ্ববিদ্যালয়টি মাত্র দেড়শ শিক্ষার্থী পেয়েছে। এ ছাড়া চলমান শিক্ষার্থীরাও টিউশন ফির পুরোটা দিতে পারছেন না। এতে পরিস্থিতি আরও কঠিন হচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের পুরো টিউশন দিতে পেরেছেন। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে রাজধানীর পান্থপথ এলাকার ভাড়ায় নেওয়া দুটি ভবন ছেড়ে দিয়েছে। উত্তরায় নির্মাণাধীন ক্যাম্পাস থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এতটা তীব্র তহবিল সংকটে আমরা এর আগে কখনো পড়িনি। বিশ্ববিদ্যালয় ঋণের ওপর ভর করে চলছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। অর্থসংকটে দুটো ভবন ছেড়ে দিয়েছি। অতিসত্বর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কোভিডের ফলে এখন পর্যন্ত অর্থসংকটে পড়েনি। তবে বিরাট অংকের পরিচালন ব্যয় নিয়ে শঙ্কিত কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ইন্ডিপেন্ডন্টে ইউনিভার্সিটির মতো কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থসংকট নেই। তবে তাদের আয় কমেছে বলে জানা গেছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আতিকল ইসলাম জানালেন, নতুন শিক্ষার্থী আগের তুলনায় কিছু কম। তবে এ কারণে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না। সব শিক্ষার্থীর জন্য ২০ শতাংশ ফি মওকুফ করা হয়েছে এবং ২০২০ সালের মার্চের পর যাদের বাবা-মা মারা গেছেন তাদেরকে বিশেষ সহায়তা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশি প্রকৌশলীর নামে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবন
অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের অবস্থাও করুণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকে ছাত্রছাত্রীদের থেকে পাওয়া ফির পরিমাণ ব্যাপকহারে কমে গেছে। ৫টি ভবন ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চলা এই বিশ্ববিদ্যালয় গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে ভাড়া পরিশোধ করতে পারছে না। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মো. ইমরান চৌধুরী এসব কথা জানান।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। প্রতি সেমেস্টারে যে হারে শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে একসময় শিক্ষকদের বেতন দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা উপাচার্যের। তিনি বলেন, প্রতি সেমেস্টারে আমাদের অন্তত ৬০০ শিক্ষার্থী দরকার, কিন্তু আমরা পাচ্ছি ২০০ জনের মতো।