পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশ

ফের সঙ্কটে পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লোগো
ইউজিসি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লোগো  © ফাইল ফটো

করোনার ধাক্কা কিছুটা সামলে অগ্রসর হওয়া দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবারও সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। শিক্ষকদের বেতন দেয়া, নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার শেষ না হওয়াসহ আরও নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তদারকি সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নেয়া সিদ্ধান্তের কারণেই এই সমস্যার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত রবিবার (৭ মার্চ) ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস ব্যতীত সব ধরনের পরীক্ষা আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়। ইউজিসির এমন নির্দেশনার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাকালীন সৃষ্ট সঙ্কট আবারও ফিরে আসছে। পরীক্ষা স্থগিতের নিবর্দেশনার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে।

ইউজিসি বলছে,  পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন। ইউজিসি শুধু মন্ত্রণালয়ের সেই সিদ্ধান্তের কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনাকালীন সময়ে ইউজিসির নির্দেশনা মেনে দীর্ঘদিন শিক্ষার্থী ভর্তি ও সব ধরনের পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছিল। এতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। এরপর ইউজিসির নির্দেশনা মেনে আবার শিক্ষার্থী ভর্তি ও পরীক্ষা নেয়া শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখন আবারও পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে করে পুরোনো সঙ্কটগুলো আবার নতুন করে পিরে আসবে।

তাদের মতে, পরীক্ষা বন্ধ হলে অনেক শিক্ষকের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। আবার অনেকে নির্ধারিত বেতন পাবেন না। করোনার শুরুতেও এই সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। কেননা বর্তমানে ৩ সেমিস্টারে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্প্রিং-২০২১ সেমিস্টার চলমান রয়েছে। পরীক্ষা না হলে নতুন সেমিস্টার শুরু করতে পারবে না এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপার্জনও বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া পরীক্ষা স্থগিত হলে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়তে হবে।  তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউজিসির এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখা এবং পরীক্ষা স্থগিত থাকায় আমরা পুরো বেতন পাইনি। আমার অনেক কলিগ আছেন যারা বেতনের কোনো টাকাই পাননি। এখন আবারও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। যেখানে বিসিএস, সাত কলেজের মতো পরীক্ষাগুলো সশরীরে নেয়া হচ্ছে। সেখানে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ মেনে নেয়া কঠিন। আমাদের অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়া উচিৎ বলেও জানান তিনি।

এ প্রসেঙ্গ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডটার্ম পরীক্ষা চলমান রয়েছে। এমন সময় ইউজিসির এই নির্দেশনা সবাইকে খুব হতাশ করেছে। উন্নত বিশ্বে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা সবই চলমান রয়েছে। অথচ ইউজিসি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি বোধগম্য নয়। এমন সিদ্ধান্তের কারণে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারির অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আশা করছি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ইউজিসি যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি আমাদের মিডটার্ম পরীক্ষা অর্ধেক হয়ে যাওযার পর দিয়েছে। হঠাৎ করে তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলো সেটি আমরা বুঝতে পারছি না। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি।

ইউজিসির এমন সিদ্ধান্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে করোনাকালীন সঙ্কট আবারও ফিরে আসবে জানিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও ফারইষ্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকারি নির্দেশনা আমাদের মানতেই হবে। তবে এমন সিদ্ধান্তে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

তিনি আরও বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উঠে দাঁড়াচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। পরীক্ষা না নিলে নতুন সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবেন না। শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে কীভাবে। শিক্ষকদের বেতনই বা দেবে কীভাবে। আমরা আশা করবো ইউজিসি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা শুধু সেটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানিয়ে দিয়েছি। ইউজিসির কিছু করার নেই। দুই/এক মাস পরীক্ষা বন্ধ রাখলে কোনো সমস্যা হবে।

ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে: পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগে পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও নেয়া হয়েছে ইউজিসি সেটি জানাতে এত দেরি করল কেন? অবিলম্বে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক।

এ প্রসঙ্গ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী শাফায়েত লিখন বলেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা সশরীরে পরীক্ষা দিচ্ছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পরীক্ষা নিলেও সমস্যা। এক দেশে বসবাস করলেও শিক্ষার্থীদের জন্য দুই রকম সিদ্ধান্ত কেন? আমরা পরীক্ষা দিতে চাই।

বিকল্প মূল্যায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো: সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত আসার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরীক্ষা ছাড়া বিকল্প মূল্যায়নের কথা ভাবছে। এক্ষেত্রে এসাইনমেন্ট মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হতে পারে। এছাড়া ক্লাসে উপস্থিতি ও ক্লাস পারফরম্যান্সও বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত আমাদের মানতেই হবে। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের বিকল্পভাবে মূল্যায়নের চিন্তা ভাবনা করছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিডটার্ম ও ফাইনাল ছাড়াও এসাইনমেন্ট, কুইজ নিয়ে থাকে। যেহেতু পরীক্ষা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে সেহেতু এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হতে পারে। কেননা সেমিস্টার শেষ না করতে পারলে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের সেশনজটে পড়তে হবে।