বাংলাদেশ ব্যাংক একাই ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে পারবে না: ইউআইইউতে ড. সালেহউদ্দিন

বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বক্তব্য রাখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করতে হলে শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক একা কাজ করে পারবে না। সেজন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং আর্থিক খাতের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।

বুধবার (৭ মে) বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) আয়োজিত 'বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের যাত্রা' শীর্ষক আলোচনা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। ইউআইইউ'র স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক্সের উদ্যোগে উচ্চশিক্ষালয়টির ক্যাম্পাসে 'বাংলাদেশ কর্পাস: পাবলিক লেকচার সিরিজ-২০২৪' এর অংশ হিসেবে অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছে। 

চলমান ব্যাংক একীভূতীকরন বিষয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি কোনো সহজ কাজ নয়। ২০০৮ সালের দিকে আমরা এমন প্রস্তাব করেছিলাম, এতদিন তারা এটি নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক যা করছে এটি মার্জার হচ্ছে না, একীভূতকরণ বলতে পারেন। প্রয়োজনে এখানে ব্যাংকগুলোকে ন্যাচরাল ডেথ এর দিকে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

'বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের যাত্রা' শীর্ষক আলোচনা

সবখানেই রাজনীতি রয়েছে জানিয়ে সাবেক এই গভর্নর বলেন, এখানে আগে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে হবে। ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে হলে স্বাধীন পরিচালক এবং দক্ষ ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ দিতে হবে, প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। 

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছে, দিতে পারছে না কাঙ্খিত গ্রাহক সেবা এবং বেড়ে চলছে খেলাপি ঋণের পরিমান। অন্যদিকে কিছু ব্যাংক উন্নত ব্যাংকিং কাঠামো অনুসরণ করতে চাইলেও বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু অনভিজ্ঞ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নীতি নির্ধারকদের জন্য তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

"যার ফলে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক এবং অপরাধীরা দুর্নীতি ও অর্থ-পাচারের মত কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই পরিচালনা করছে আর অন্যদিকে সাধারণ জনগণ ও বিদেশে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং গ্রাহক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। মুদ্রানীতি নিয়ে আপত্তি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মুদ্রানীতি হচ্ছে, এতে পলিসিগত কিছু সমস্যা রয়েছে।"

"এখন আমাদের সমস্যাগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের স্থবিরতা এবং প্রবৃদ্ধির স্থবিরতা। এর পেছনে কিছু পলিসিগত সমস্যা রয়েছে। অবশ্যই দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যারও ভূমিকা রয়েছে এতে।" 

'বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের যাত্রা' শীর্ষক আলোচনায় ড. সালেহউদ্দিন

ড. সালেহউদ্দিনের মতে, বর্তমানের সমস্যা ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আমরা অনেক সময় গৎবাঁধা কিছু পলিসি অনুসরণ করে থাকি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশনে। যেমন সম্প্রতি আইএমএফ আমাদের কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আইএমএফের কিন্তু চিরাচরিত তিনটা নীতি আছে, প্রথমত নমনীয় বিনিময় হার, দ্বিতীয়ত নমনীয় ও উচ্চ সুদহার (দেয়ার ইজ নাথিং কলড চিপ মানি) এবং তৃতীয়ত হলো কঠোর মুদ্রানীতি। এরা আপ্তবাক্যের মতো তিনটি নীতি অনুসরণ করতে বলে। এই তিনটিই অ্যাডাম স্মিথ বর্ণিত অদৃশ্য হাত (ইনভিজিবল হ্যান্ড) যেন সব কাজ করে ফেলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বাইরে অনেক বিষয় আছে যেখানে আমাদের গৎবাঁধা পলিসির বাইরে যেতে হবে।

সাবেক গভর্নর বলেন, নমনীয় বিনিময় হারের দরকার আছে, এটি একেবারে নমনীয় বিনিময় হার করলে বিপদও আছে। সম্প্রতি যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ নীতির কথা বলছে। কিন্তু একেবারে কঠোর মুদ্রানীতিও কিন্তু অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। আমরা অনেকদিন নয়-ছয়ের ফাঁদে ছিলাম। আবার এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এসবের বাইরে যদি না যাই তাহলে হবে না। 

উদাহরণ হিসেবে ড. সালেহ বলেন, আর্জেন্টিনা প্রায় ৪০-৫০ বছর ধরে আইএমএফের প্যাকেজ গ্রহণ করছে। কিন্তু তারা এখনো বের হতে পারেনি। পাকিস্তান তো আরেকটি উদাহরণ এক্ষেত্রে। সম্প্রতি দেখলাম কয়েকটি দেশ ঋণে ভারাক্রান্ত দরিদ্র দেশে (এইচআইপিসি) পরিণত হয়েছে। ভাগ্যক্রমে সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। আশা করি বাংলাদেশ এ রকম দেশ হবেও না। কেননা এ দেশের অবস্থা এতটা শোচনীয় নয়। কিন্তু আমাদের এ বৈদেশিক ঋণসহায়তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন অধ্যাপক ড. মো. মুসা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাঈন উদ্দিন হাসান রশিদ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থী এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।


সর্বশেষ সংবাদ