বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ প্রজন্ম গড়তে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে ইউএপি: ড. কামাল আবদুল নাসের

বক্তব্য রাখছেন ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী
বক্তব্য রাখছেন ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী  © টিডিসি ফটো

নবীন গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেছেন, বহমান জীবন অভিজ্ঞতায় অনন্য ও স্মরণীয় এক দিন আজ। তরুণ প্রজন্মের অর্জন ও গৌরবের এই উন্মুখর শুভক্ষণে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। 

শনিবার (৪ মে) সকালে রাজধানীর পূর্বাচলের বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) দশম সমাবর্তনে আচার্যের পক্ষে সভাপতিত্বকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এসময় তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে স্মরণ করে ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির আন্দোলন সংগ্রামের প্রতিটি পর্বে তিনি অনুধাবন করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া জাতির ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের। শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তাঁর। স্বাধীনতার পর তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠেছিল দেশ। তখন পর্বতসম সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁকে, তবু শিক্ষাকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। 

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী

তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষার্থীদের বইসহ শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, কুদরত-ই-খুদা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপসমূহ শিক্ষার মানোন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর এই শিক্ষা ভাবনার মূলকেন্দ্রে ছিল জনগণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন:

"সুস্থ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার ৮০ ভাগ অক্ষরজ্ঞানহীন।... নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ক্রাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না যায়।"

তিনি বলেন, বিনিয়োগকে আমরা সাধারণত আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই বিনিয়োগের ধারণাকে আরো বিস্তৃত পরিসরে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি সে জন্য পরবর্তীসময়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্র নির্মাণকালে বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন।

শিক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানের বিষয় উল্লেখ করে ড. কামাল আবদুল নাসের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সরকার পরিচালনাকালে শিক্ষাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শিক্ষা এখন আর মুষ্টিমেয় তথাকথিত কিছু অভিজাত শ্রেণির মধ্যে কুক্ষিগত নয়। তাঁর শাসনামলে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার দ্বারও এখন দেশব্যাপী উন্মুক্ত। বর্তমানে সারা দেশে ৫৩টি সরকারি ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউজিসির তথ্য অনুসারে অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসাসহ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার ধারণা ও পদ্ধতির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে, প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের জীবন-কর্ম, চাহিদা ও সামাজিক অভিজ্ঞতা। বর্তমানে পৃথিবী চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের যুগ অতিক্রম করছে। পূর্বতন যেকোনো বিপ্লবের তুলনায় চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের গতি দ্রুততম ও এর বিস্তৃতি ব্যাপক। এরকম পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সময়ের সঙ্গে অভিযোজন জরুরি। সরকার এ বিষয়টি সামনে রেখে শিক্ষা পদ্ধতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তাদের শিক্ষাক্রমে যুগপৎ জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটাতে হবে।

“নতুন গ্র্যাজুয়েটদেরও মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো অর্জনই উদ্‌যাপনের কিন্তু অর্জনকে ধরে রাখতে হয়। জীবন এক অন্তহীন লড়াই-এখানে পরিতৃপ্তির স্থান খুবই সীমিত। প্রতিমুহূর্তে নিজের সম্ভাবনা ও সক্ষমতাকে আবিষ্কার করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান ও সক্ষমতা অর্জিত হয় তাকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে কর্মজীবনে দক্ষভাবে প্রয়োগ করাই সাফল্য। আমি আশা করি, নবীন স্নাতকরা এই সাফল্য অর্জন করে দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে।”

ড. কামাল আবদুল নাসের বলেন, ২০০৮ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা করে তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কারণ তখন ইশতেহারে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দিন বদলের কথা বলেছিল। পরিবর্তনকে মানুষ সাধারণত ভয় পায়। কিন্তু সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনকে ভয় পেলে চলবেনা। বরং সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। এবারের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ- যার মাধ্যমে শতভাগ শিক্ষিত নাগরিকেরা নতুন জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেদের ও সমাজের সকলের জীবন ও জীবিকার মান বদলে দেবে। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে আমরা সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পারি।

অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-স্যাম্পেইন এর এডওয়ার্ড উইলিয়াম এবং জেন মার গুটসেল প্রফেসর ড. মো. তাহের আবু সাইফ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর।

এবারের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে সর্বমোট ৫ হাজার ৯৭৭ জন শিক্ষার্থীকে সনদ দেওয়া হয়। এরমধ্যে স্নাতক পর্যায়ে ৪ হাজার ২১৬ জন এবং স্নাতকোত্তরে ১ হাজার ৭৬১ জন শিক্ষার্থী ডিগ্রি গ্রহণ করেন।


সর্বশেষ সংবাদ