অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষা
- তৌহিদুজ্জামান
- প্রকাশ: ১২ জুন ২০২০, ০৯:৫৩ PM , আপডেট: ১২ জুন ২০২০, ১০:০০ PM
সব শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। যার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাঙালি জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়তে ১ জুলাই ১৯৭৩ সালে এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। তারই সূত্র ধরে জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে।
ফলে প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি মর্যাদা পেলেও তাঁরা অনেকাংশে অবহেলিত এবং নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার। সারাদেশে ৬৫ হাজার ৫৯ জন প্রধান শিক্ষকের পদ রয়েছে এবং ৫০ হাজারের কাছাকাছি পদের প্রধান শিক্ষক রয়েছেন।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা দেন এবং একই দিনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে।
কিন্তু মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল নির্ধারণ করে প্রবেশ পদে ১১তম গ্রেড (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) ও ১২তম গ্রেড (প্রশিক্ষণবিহীন)। অথচ নন-ক্যাডার দ্বিতীয় শ্রেণির পদে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ গ্রেডে বেতন পান। প্রধান শিক্ষকদের পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতন ধাপ আপগ্রেড করা প্রয়োজন।
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকও কর্মরত রয়েছেন। যোগ্যতাভিত্তিক স্কেল পাওয়া প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রাণের দাবি। প্রাথমিক শিক্ষকদের পাঠদান ছাড়াও বিভাগবহির্ভূত অনেক কাজ করতে হয়।
বিদ্যালয়ে রুটিনমাফিক কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হচ্ছে। অথচ শিক্ষকদের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা জেলা শিক্ষা অফিসারের সমান গ্রেডে বেতন পেয়ে আসছেন। সহকারী শিক্ষকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেতন পান।
অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যাপারে শিক্ষা বিভাগের নজর নেই। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাজের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু না বাড়ছে তাঁদের মর্যাদা, না বাড়ছে সুযোগ–সুবিধা। এভাবে শিক্ষার বনিয়াদ দৃঢ় হতে পারে না।
শিক্ষায় মানোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর তার প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষকদের যথাযথ মান মর্যাদা নিশ্চিত করা। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার প্রথম ধাপ। শুধু শিক্ষক না এই বিভাগের কর্মরত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার মাঝে উপযুক্ত সম্মান না পাওয়ার ক্ষোভ বিরাজমান আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
যতদিন না বেতন বৈষম্য ঠিক হবে এবং মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি কার্যকর হবে ততদিন প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই সমস্যা দূর না করলে প্রাথমিক এর মান বাড়ানো যাবে না।
অল্প কিছুদিন চাকুরি করার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কিছু সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছি যা উল্লেখ করা খুবই জরুরি বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
১. প্রাথমিকের শিক্ষকদের কোনো পদোন্নতি নেই। অর্থাৎ ভালো করলে উত্তরোত্তর উন্নতি বা ইনসেন্টিভের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার ফলে মেধাসম্পন্ন মানুষের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
২. মাধ্যমিক স্কুল-কলেজের ছুটি ৮৫ দিন হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটি ৭৫ দিন।
৩. এটি নন-ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট হওয়ায় তাদের অর্জিত ছুটি ভোগ করেও শান্তি নেই, পিআরএলে যাওয়ার সময় এ ছুটি তাদের বিয়োগ করে ল্যামগ্রান্ট হিসাব করার বিধান আছে।
৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সরকারি কাজে এখানে-সেখানে যাওয়া লাগে এবং সেখানে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে শিক্ষকদের বসার কোনো ব্যবস্থা পর্যন্ত রাখা হয় না। তাদের মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতে হয় নতুবা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
৫. প্রত্যেক জাতীয় দিবসে শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে যেতে হয়, অথচ এ দিনগুলো ছুটি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. বিদ্যালয়ের বরাদ্দের সব কাজ করেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তার ইচ্ছামতো। অথচ অফিশিয়াল সব ঝামেলা পোহাতে হয় প্রধান শিক্ষককে।
৭. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দেওয়া। এই সময়ে একেকজন শিক্ষককে প্রতিদিন ৭ থেকে ৯টা ক্লাসও নিতে হয়। এতগুলো ক্লাস একজন শিক্ষকের পক্ষে নেওয়া কি সম্ভব? আর নিতে গেলে ক্লাসের মান কখনো ভালো হওয়া সম্ভব না। জন্মনিবন্ধন, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনসহ সরকারি অনেক কাজে তাদের ব্যবহার করা হয় অনেকটা বিনা পয়সায় খাটুনির মতোই।
শিক্ষাবান্ধব সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা যে, বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করে এই বিভাগে যাতে আরো মেধাসম্পন্ন মানুষ আসতে পারে সেই সুযোগ সৃষ্টি করা।
লেখক: তৌহিদুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক (৩৬ তম বিসিএস নন-ক্যাডার)
১০১ নং পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ