ছাত্রলীগ নেতার ‘খুনি’ এখন আ. লীগের প্রভাবশালী নেতা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:০৪ AM , আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:০৪ AM
১৯৯৯ সালের ২৬ মার্চ ছাত্রলীগ রাজশাহী মহানগর কমিটির সহসভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির (মাস্টার্স) ছাত্র গোলাম মুর্শিদ ওরফে গোলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের একজন আজিজুল আলম বেন্টু। হতাকাণ্ডের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এখন তিনি রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আর তাঁর বড় ভাই একই হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি রবিউল আলম বাবু রাজশাহী জেলা কৃষক লীগের সভাপতি।
নগরীর হড়গ্রাম এলাকার বাসিন্দা আজিজুল আলম বেন্টু ট্রাকচালক ছিলেন। এ পেশা ছেড়ে কিছুদিন মাছও বিক্রি করেছেন। বাড়িতে গরুর খামার করে দুধ বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন রাজশাহীতে তাঁর শতকোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। বালুমহাল থেকে শুরু করে সরকারি জমি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাসস্থান দখল, ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে সাধারণ মানুষের জমি কেনার অভিযোগ রয়েছে বেন্টুর বিরুদ্ধে। তাঁর এই দাপটের পেছনে রয়েছে অস্ত্রধারী সহযোগীরা।
গোলাম হত্যায় বেন্টুর যাবজ্জীবন সাজা : ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে রাজশাহী নগরের কোর্ট এলাকায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্রমৈত্রীর প্রবল প্রভাব তছনছ করে দিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছিলেন যাঁরা তাঁদের অন্যতম ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা গোলাম। ছাত্রমৈত্রীর তীব্র বাধার মুখে তিনি কোর্ট ঢালান মোড়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ করেছিলেন। তখনকার বিরোধী দল নেতা শেখ হাসিনা একবার রাজশাহী সফরের সময় গোলামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আরেকবার রাজশাহী সার্কিট হাউসে তাঁকে ডেকে আদর করে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তিনি।
কিন্তু এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে বিরোধের জের ধরে বেন্টুর নেতৃত্বে তাঁর বড় ভাই ছাত্রমৈত্রীর রাজশাহী মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি রবিউল আলম বাবুসহ একটি দল গোলামকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ১৪ জনকে আসামি করে নগরীর রাজপাড়া থানায় মামলা হয়। ২০০৫ সালের ৮ মে বাবু ও বেন্টুসহ ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। প্রায় ৯ মাস কারাভোগ করেন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা। পরবর্তী সময়ে তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন। এরপর আসামিদের আবেদনে উচ্চ আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ নিয়ে আর কোনো আপিল করেনি। আর্থিক টানাপড়েন এবং বেন্টুর ভয়ে গোলামের পরিবার মামলার তদবির করতে পারেননি। ক্ষোভে তাঁরা আর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও নেই।
নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল হুদা রানা বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে গোলাম হত্যার রায় কার্যকর দেখতে চাই।’গোলামের ভাই এস এম গোলাম জিলানী রাজু বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের সাজার রায় কার্যকর দেখতে চাই।’
এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা বেন্টু বলেন, ‘এই মামলায় কেন আসামি হলাম, কেন বা জেল খাটলাম, তার অনেক বড় কাহিনী আছে। এর পেছনে কারা ছিল সেটি জানতে হবে।’
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘গোলাম ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ নেতা। তাঁর মতো একজন নেতাকে হত্যা করা সত্যি বেদনার বিষয়। হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন বেন্টুসহ তাঁর পরিবারের লোকজন। তার আগে তাঁরা ওয়ার্কার্স পার্টি করতেন।’
ট্রাকচালক থেকে শত কোটি টাকার মালিক : অভিযোগ রয়েছে, নগরীর তালাইমারী এলাকায় একটি বালুমহাল জোর করে দখলে রেখেছেন বেন্টু। ২০১৮ সাল পর্যন্ত আগের পাঁচ বছর তিনি ১১টি বালুঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন। যে ঘাটটি গোপনে মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় ইজারা নিতেন বেন্টু, সেটি চলতি বছর তাঁকে প্রকাশ্যে দরপত্রের মাধ্যমে দুই কোটি দুই লাখ টাকায় নিতে হয়েছে।
নগরের বাইপাস মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে বিশাল একটি জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করেছেন বেন্টু। এর মধ্যে অন্তত ১৫ ফুট জায়গা সড়ক ও জনপথ বিভাগের। এটা ছিল জলাধার। বাকি অংশের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল পুকুর।
স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর মালতি রানী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাস তিনেক আগে আমাদের বাড়ি ভেঙে সরে যেতে বলেন বেন্টুর লোকজন। আমরা ভয়ে আর কোনো প্রতিবাদ করিনি।’
রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা বলেন, ‘রাস্তার দুই পাশেই আমাদের জমি আছে। এগুলো ভরাট করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু অনুমতি নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নাই।’
জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে নগরীর আলুপট্টি এলাকায় প্রায় ১০ কাঠা জমি কেনেন বেন্টু। বিরোধপূর্ণ এই জমিটি একটি পক্ষের কাছ থেকে জোর করে পানির দরে কিনে নেওয়া হয়। এর মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এরপর বেন্টু সেখানে গড়ে তোলেন কার্যালয়, যেটি টর্চার সেল নামে পরিচিত। এখানে বছরখানেক আগে একজন ঠিকাদারকে ধরে এনে জোর করে দুই কোটি টাকার বালু নিতে বাধ্য করেন বেন্টু। তাঁর আরো একটি কার্যালয় আছে নগরীর কোর্ট স্টেশন এলাকায় রেলওয়ের জমিতে। এটাও টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।
এ ছাড়া নগরীর তালাইমারীতে রয়েছে বেন্টুর আরেকটি জায়গা। কাড়িরপুরে কিনেছেন প্রায় পাঁচ বিঘা জমি, দামকুড়ায় কিনেছেন আরো বিপুল সম্পত্তি। নগরীর বাইপাস সড়ক থেকে টুলটুল পাড়া রেললাইন পর্যন্ত রেলের জমি দখলে রেখেছেন তিনি। কোর্ট বাজার মাছপট্টিতে সিটি করপোরেশনের জায়গা দখল করে মার্কেট করে ভাড়া তোলেন বেন্টু। তাঁর রয়েছে আটটি ড্রাম ট্রাক, একটি ভেকু মেশিন, একটি এসকাভেটর ও বিলাসবহুল গাড়ি।
বছর দুয়েক আগে বেন্টুর ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ চর শ্যামপুরে ঘাট দখল নিয়ে কাঁটাখালি পৌরসভার মেয়র আব্বাসের লোকজনের ওপর গুলি চালিয়েছিল। ওই সময় বেন্টুকে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা করতে চেয়েছিলেন গুলিবিদ্ধ নজরুল হকের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারণে বেন্টুকে আসামি করা যায়নি। সম্প্রতি শফিকুল ইসলাম সুমন নামের এক যুবককে কুপিয়ে জখম করে বেন্টুর সহযোগীরা। ৫০টির বেশি অবৈধ অস্ত্র বেন্টু ও তাঁর বাহিনীর কাছে রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সম্পদের বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুল আলম বেন্টু গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করিনি।’ আলুপট্টি এলাকায় জমি কেনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই জমি নিয়ে বিরোধ আছে কি না আমার জানা নেই।’ অন্যসব অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে এত কিছু বলা সম্ভব নয়।’