২৯ মে ২০২৫, ১২:১৭

ডিসেম্বরেই কেন নির্বাচন চাইছে বিএনপি?

বুধবার রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করেছে বিএনপি  © বিবিসি বাংলা

দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক বিএনপি নির্বাচন নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছে আলটিমেটামের সুরে। নয়াপল্টনে এক সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য দেওয়া হলো বলে মত বিশ্লেষকদের। খবর বিবিসি বাংলার।

প্রশ্ন উঠেছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের জন্য কেন চাপ বাড়াতে চাইছে বিএনপি? কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে তারা? নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়ে এগোতে গিয়ে রাজনীতিতে বিএনপি একা হয়ে পড়বে কিনা, এ মন আলোচনাও রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ বিএনপির এ অবস্থানের সঙ্গে নেই বর্তমানে রাজনীতিতে প্রভাবশালী অন্য দলগুলো, বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী।

নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থানের প্রতি দলগুলোর সমর্থন রয়েছে বলা যায়। তবে বিএনপিও অভিযোগ করছে, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপি এবং সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে।যদিও সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বললে তারা এ ধরনের অভিযোগ মানতে রাজি নন। দলটির নেতাদের বক্তব্যে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল এখন সামনে এসেছে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব ডিসেম্বরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি দেশের মানুষের প্রতিও আহবান জানিয়েছেন।

দলটির নেতারা বলছেন, বাধ্য না হলে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে না। এমনকি সরকার ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায় না বলে তারা মনে করেন। সে কারণে সরকারকে বাধ্য করানোর চেষ্টা তাদের থাকবে। তাদের বক্তব্য বা চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়ে সরকারের দিক থেকে তাৎক্ষণিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার জাপান সফরে গিয়ে দেশটির সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার পুরানো অবস্থানই তুলে ধরেছেন।

অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা সামাল দিতে তিনি শনি ও রোববার দুই দিনে ২২টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় সংকটের সমাধান হয়েছে বলা হচ্ছে। রাজনীতিকদের অনেকে এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, আপাতত উত্তেজনা থেমেছে। কিন্তু সরকারের অংশীজনদের মধ্যে বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কমেনি; রয়ে গেছে অস্বস্তি।

নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, এই ধারণা তৈরি হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এবং দেশের রাজনীতিতে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভোটের মাঠে অন্য কোনো দলকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে না বিএনপি। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তৈরি হওয়া সুযোগ বা সম্ভাবনা দ্রুত কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা বিষয় রয়েছে।

নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, এই ধারণা তৈরি হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এবং দেশের রাজনীতিতে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ভোটের মাঠে অন্য কোনো দলকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে না বিএনপি। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তৈরি হওয়া সুযোগ বা সম্ভাবনা দ্রুত কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা বিষয় রয়েছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, বিএনপি ইতোমধ্যেই ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে––এমন চিন্তা থেকে রাজধানী থেকে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকে আধিপত্য বিস্তার, দখল, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত নেতা-কর্মীদের অনেককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং এমনকি বহিষ্কার করাসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু থামানো যায়নি বিএনপির নেতা-কর্মীদের দখল, চাঁদাবাজির মতো অপরাধ।

এ পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের মাঝে বিএনপি সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে; অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে দলটিকে। নেতা-কর্মীদের এ সব অপরাধের অভিযাগ নিয়ে চিন্তিত বিএনপির নেতৃত্ব। তারা মনে করছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে যত দেরি হবে, দলের নেতা-কর্মীদের সামলানো তত কঠিন হবে; দখল, চাঁদাবাজি ও অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বা এ ধরনের অপরাধ বাড়তে থাকবে।

এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন দেরিতে হলে কতটা সহায়ক পরিস্থিতি থাকবে, সেটা দলটিকে ভাবাচ্ছে। হয়তো তারাই ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু সমালোচনা বাড়বে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বও কাজ করছে বিএনপির ভেতরে। দলটির নেতারা মনে করছেন, এনসিপির প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের দুর্বলতা বা পক্ষপাতিত্ব আছে। দলটি সংস্কার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার শেষ করার পর নির্বাচন চায়।

আর জামায়াত সুবিধাবাদী একটা অবস্থান নিচ্ছে। দুটি দলের সঙ্গে ইসলামপন্থি আরও কিছু দলকে এক অবস্থানে এনে সরকার বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে। এমন ষড়যন্ত্রের অভিযোগও বিএনপি আনছে। জামায়াাত ও এনসিপি এমন অভিযোগ মানতে রাজি নয়। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আগামী বছর রোজার আগ বা পরে নির্বাচন চান তারা। তাদের এই অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখা ঠিক হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ভোট হলেই বিএনপির ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত, এ বাস্তবতা থাকার পরও বিএনপিকে ঠেকানো যায় কিনা- এ ধরনের ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা রয়েছে বলেও বিএনপি নেতারা বিশ্বাস করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ক্ষমতায় থাকার লোভ তৈরি হয়েছে, সেজন্য নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা রয়েছে, এমন ধারণা থেকে বিএনপি নেতারা এখন সরকারের সমালোচনা করছেন।

বুধবার ঢাকায় বিএনপির আয়াজনে তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপি নেতা তারেক রহমানও বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মনে হয় এর ভেতরে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যত। জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ও বাইরে কারও কারও মনে হয় ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকাররে দুর্বলতার বিষয়কেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে সরকারও ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আওড়াচ্ছে। এর মধ্যে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা কাজ করছে বলেও বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন।

আর সেজন্যই বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচন করার জন্য সরকাররে ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়ে এবার মাঠে নামছে। কারণ ডিসেম্বরেই নির্বাচন করতে হবে, এই অবস্থানে নেই জামায়াত, এনসিপি এবং ইসলামপন্থি বেশিরভাগ দল। অন্তর্বর্তী সরকারও ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে চায় না। যদিও সব দলই নির্বাচন ও এর রোডম্যাপ চায়। কিন্তু নির্বাচনের সময়ের প্রশ্নে বিএনপি ছাড়া অন্য এসব দল ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন দিচ্ছে।

বামপন্থি কিছু দল বিএনপির সঙ্গে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। তবে রাজনীতিতে এখন বামপন্থি দলগুলোর তেমন প্রভাব নেই। এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামপন্থি দলগুলাকে ঐক্যবদ্ধ করে বিএনপিকে কোণঠাসা করা বা তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করনোর চেষ্টা রয়েছে বলে যে আলোচনা রাজনীতিতে চলছে, সেটি বিএনপিও বিবেচনায় নিচ্ছে। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা রাজনীতিতে একা হয়ে পড়লেও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য তারা সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীজনদের মধ্যে নিজেকে বড় শক্তি হিসেবে দেখে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, অংশীজনদের বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তারা যদি সরকারকে সহযোগিতা না করেন, তাহলে সরকার চাপে পড়বে। কারণ সরকারের টিকে থাকার প্রশ্ন আসবে। এ ধরনের চিন্তা থেকে গত কয়েকদিনে বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার একটা বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে যে, সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে তাদের পক্ষে সরকারকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ সহযোগিতা না করার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।

ফলে দলটি সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে সহযোগিতা না করার ঘোষণাও দিতে পারে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তারা সমাবেশ-গণজমায়েতের মতো গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে চান। দলটির ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকারর বাধ্য না হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে না। ফলে সরকারকে বাধ্য করার চেষ্টাও থাকবে বিএনপির।

ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে বলে বিএনপির শীর্ষ নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন করার পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেন। তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তায় মনে হয়েছে, সরকার আগামী বছরের আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায় না।

এ ধারণা বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে। কারণ প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে যে সংকট হয়েছিল, সে পটভূমিতে গত শনি ও রোববার অধ্যাপক ইউনূস বিএনপিসহ দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও এ সরকার আগামী বছরের ৩০ শে জুনের পর একদিনও ক্ষমতায় থাকবেন না। এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন সরকার করবে না, প্রেস সচিবের ওই বক্তব্যে সেটা পরিষ্কার বলে বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

বুধবার যখন বিএনপির সমাবেশ থেকে আলটিমেটামের সুরে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া হয়েছে, সেদিনই জাপান সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা আবারও ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের পুরোনো অবস্থানই তুলে ধরেছেন।

লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই গণ-অভ্যত্থানের মাধ্যমে গঠিত এ সরকার যদি কিছু সংস্কার করতে না পারে, তাহলে সরকারের মুখ রক্ষা হবে না। সে কারণে সরকার হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের জন্য সময় হাতে রেখে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স সাড়ে নয় মাস পার হয়েছে। এ সময়ে সংস্কার কাজ কিছুই হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়ও সরকার বলেনি বা রোডম্যাপ দেয়নি।

সেজন্যই বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখনো সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটেই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি সংকট তৈরি হয়েছিল। এর আগের সপ্তাহে আদালতের রায় অনুযায়ী বিএনপি তাদের একজন নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণার দাবিতে রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে রাজধানী কার্যত অচল করে দিয়েছিল।

সে সময় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বৈঠকে বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। এ দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে এনসিপির নাহিদ ইসলামকে ডেকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তার পদত্যাগের ভাবনা কথা জানানোর ক্ষেত্রে দলগুলোর অসহযোগিতার বিষয় তুলে ধরেছিলেন। নাহিদ ইসলামের মাধ্যমে তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং উত্তেজনা তৈরি হয়। পরিস্থিতি সামলাতে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত সভা করে এক বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ওই সব পদক্ষেপে সরকার একটু শ্বাস নেওয়ার সময় পেয়েছে। আপতত উত্তেজনা কমেছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে অস্বস্তি রয়েছে। কারণ সরকারের সঙ্গে বিএনপি এবং সেনাবাহিনীর দূরত্ব কমেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান মনে করেন, সরকার তাদের অংশীজনদের মধ্যে বড় দুই শক্তি বিএনপি ও সেনাবাহিনীকে ধমক দিয়েছে। ফলে উত্তেজনা ও অস্বস্তি রয়ে গেছে। এমন বক্তব্যের পেছনে তিনি উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে থাকা বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

আরও পড়ুন: কুবিতে সাংবাদিকদের ওপর ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের হামলা

বিবৃতিতে এটাও উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ার–বহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে। সরকারের এই দুই বক্তব্যে ধমক দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি নেতারাও মনে করেন।

বিএনপির মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংকট এখন থমকে আছে। যা আরও প্রকটভাবে দেখা দিতে পারে।

ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে থাকা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলম এবং এই দুজনের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তাা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপি নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে রাখা হয়। এর মাধ্যমে বিএনপিকে কী বার্তা দেওয়া হলো, তা নিয়ে দলটির ভেতরে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে এবং সরকারের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়েছে।

দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে বৈঠকে উপস্থিত রাখার রাজনৈতিক অর্থ রয়েছে। সরকার বিএনপির দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, এটি হতে পারে। বিএনপি নেতারা ঘটনাটিকে সরকারের ঔদ্ধত্য বলে বর্ণনা করছেন। আসলে বিষয়টাকে সহজভাবে নিতে পারেনি দলটি। তারা মনে করেন, সরকার বিএনপি ও সেনাবাহিনীর ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে। সে কারণে সাময়িক উত্তেজনা কমলেও দেশের মানুষকেও স্বস্তি দিতে পারছে না পরিস্থিতি।

যদিও এ ধরনের বক্তব্য মানতে রাজি নন সরকারের উপদেষ্টারা। অন্যদিকে, মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার হাত দিচ্ছে, যেগুলাে বিতর্কের সৃষ্টি করছে। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশােধন করায় সচিবালয়ে কর্মকর্তা কমচারীরা পর্যন্ত আন্দােলনে নেমেছেন। রাজনীতিকরা মনে করছেন, সব ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন একটা পরিস্থিতি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এর মধ্যে যেহেতু সরকারের বড় অংশীজনদের মধ্যে সরকারকে ঘিরে সন্দেহ, অবিশ্বাস রয়ে গেছে। ফলে অস্থিরতা বা উত্তেজনা আবারও বাড়তে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে নির্বাচন করতে হলে সরকার ও অংশীজনদের সব পক্ষের সমঝোতা প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।