মাঠের প্রচারণা বন্ধ, চলছে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:১৯ AM , আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:২৮ PM
স্বাধীন বাংলার আগের কথা। যখন সমাবেশ-বক্তৃতা প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার মাইকের ব্যবহারও ততটা ছিল না। ব্যবহৃত হত টিন বা প্লাস্টিকের চোঙ্গা। সে সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস, লোকে জানবে এই একটা লোক একটা টিনের চোঙ্গা হাতে নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিল এবং সারা জীবন সেই টিনের চোঙ্গায়—বাঙ্গালি, বাঙ্গালি চিৎকার করেই মারা গেল।’
চোঙ্গার যুগ হারিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ‘কলরেডি’ কিংবা জিয়াউর রহমানের ‘তাহের’ নামক নামিদামি মাইক কোম্পানীগুলোও আজ প্রায় পথে বসেছে। বিপরীতে জায়গা করে নিয়েছে ভিনটন জি কার্ফের ‘ইন্টারনেট’। আরেকটু স্পষ্ট করলে বলতে হয়- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক, জ্যাক ডোরসেই’র টুইটার কিংবা স্টিভ চেম ও চাদ হার্লির ইউটিউব।
নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়েছে শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায়। এরপর থেকে মাঠে-ময়দানে নেই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা। প্রচারণা চালাচ্ছেন বিকল্প পন্থা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থীদের পোস্টার ও ভিডিও চিত্র তৈরি করে অনলাইনে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছিল; সেটিই এখন আরো জোরেশোরে চলছে আগামীকালের নির্বাচনকে ঘিরে। অনেক প্রার্থী নিজেই ভিডিও বার্তা দিয়ে ভোট চাইছেন। আবার অনেক প্রার্থীর সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। এসব বিষয়গুলো নজরে আনছেন না নির্বাচনী কর্মকর্তারা। কর্মীরা বলছেন, এগুলো ভার্চুয়াল প্রচারণা। চাইলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নজরদারি করা কঠিন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ঘেঁটে দেখা গেছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণার সময় শেষ হলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকের পোস্টার দিয়ে ভোট চাইছেন নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে। অন্যদিকে, বিএনপি প্রার্থীরা চাইছেন ধানের শীষ প্রতীকে। দলের অফিসিয়াল পেজ থেকেও ভিডিও চিত্র আপলোড করা হচ্ছে ভোট চেয়ে। শুধু প্রার্থীরাই নয়, তাদের সমর্থকরা একই কায়দায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধিতে রঙিন পোস্টার, লিফলেট ছাপানো নিষিদ্ধ থাকলেও তা দৃশ্যমান ফেসবুকে। প্রার্থীর পক্ষের লোকজন এমন প্রচারণা চালিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছেন। অথচ রাত পোহালেই বহুল প্রত্যাশিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সিরাজগঞ্জ-৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী এক প্রার্থী জানান, অনলাইন প্রচারণার সীমা নেই। এটি দু’দিন আগে কেন, ভোটের দিনও চলতে পারে বলে আমি মনে করি। তাই এখনোও এই মাধ্যমটিকে ব্যবহার করছি।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এখনকার তরুণদের কাছে মাইকিং, ব্যানার, পোস্টারিং দিয়ে পৌঁছানো যাবে না। সিংহভাগ তরুণ অবসরে কিংবা কাজের সময় তাকিয়ে থাকেন মোবাইল, ট্যাব কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে। তাই তাদের কাছে বার্তা পৌঁছাতে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই সবচেয়ে ভালো উপায়। বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউব। ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি পার্পলবট ডিজিটাল’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার মাহমুদ মনে করেন, ‘তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দেয়াল পোস্টারিং ও লিখনের জায়গা ফেসবুকের ওয়াল, উঠান বৈঠকের স্থান ফেসবুক লাইভ, নাটিকা প্রদর্শনীর স্থান ইউটিউব ভিডিও এবং ব্যানারের স্থান স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট দিয়ে প্রচারণা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে। এটি এ সময়ের যোগাযোগের একটি বড় পরিবর্তন। যা প্রার্থীদের যোগাযোগ কৌশল পরিবর্তনেও ভূমিকা রেখেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তরুণরা আবেগের চেয়ে বিবেককে প্রাধান্য দিবে। দল এবং প্রার্থীর ভালো-মন্দ বিচার করে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এটা বিচার করতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই বেশি গুরুত্ব দিবে। যেহেতু এখানে দল এবং প্রার্থীর ভালো-মন্দ বিচার করার অনেক বিষয় উঠে আসছে। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র বোরহান উদ্দীন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণায় তরুণ ভোটারদের বেশি প্রভাব ফেলবে। কেননা অধিকাংশ তরুণ ভোটারের হাতে স্মার্ট ফোন রয়েছে। এতে তারা প্রতিনিয়তই অনলাইন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কানেক্টেড থাকে।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবির নামে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, আমরা চাই একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আবারও ক্ষমতায় আসুক। তিনি বলেন, এবারের ভোটে তরুণ প্রজন্ম অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। তরুণরা যেহেতু ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব, সেহেতু প্রার্থী ও দলের কর্মকান্ড দেখে কাকে ভোট দিবে সেটা সিদ্ধান্ত নিবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস সূত্রে জানা যায়, ১০ বছর আগে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ, এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। ব্যবহারকারী বাড়ায় নির্বাচনে অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আরেকটি সূত্রের তথ্য, ঢাকায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। সংখ্যার দিক দিয়ে যা পৃথিবীর ফেসবুক ব্যবহারকারী শহরের মধ্যে দ্বিতীয়। আর সারাদেশে এই চিত্র হলো- মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক ফেসবুক ব্যবহার করেন। তাই তো প্রার্থীরা বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছাতে ফেসবুকে পেজে পোস্ট দিচ্ছেন এমনকি ‘বুস্ট’ও করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো চাইলেও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফেসবুক, গুগল—এরা বিটিআরসির অনুরোধ রাখতে বাধ্য নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কন্ট্রাক্টও তাদের নেই। তবে বিটিআরসি অনুরোধ করলে তারা তাদের পলিসির মধ্যে থেকে কিছু অনুরোধ রক্ষা করে। বাংলাদেশে ফেসবুকের গ্রাহক তিন কোটির মতো। গ্রাকদের স্বার্থই ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে বেশি প্রাধান্য পায়।
এর আগে অবশ্য সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি। সে সময় ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির একাধিক সদস্য বলেছিলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেসবুক, টুইটার, ভাইবারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো প্রার্থী বা সমর্থক বা রাজনৈতিক দল কোনো প্রচারণা চালাতে পারবে না—এ ধরনের একটি বিধান বিধিমালায় সংযোজন করার প্রস্তাব তাঁরা করেছেন। কর্মকর্তারা আরো বলেছিলেন, নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকের অপব্যবহার হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা আছে। মূলত এ কারণে এই ধারাটি বিধিমালায় সংযোজন করার চিন্তা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ২০১৩ সালেও এ ধরনের একটি চিন্তা ছিল বলে জানায় ইসি সূত্র।