কাজই জীবন, আনন্দ ও সাফল্য
কলকাতা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পাস করার পর আমি প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম সাতক্ষীরায় নিজের গ্রাম রসুলপুরে। সময়টা ১৯৫৩ সাল। বাড়ির কাছে একটি ফার্মেসি ছিল। সেখানে প্রতিদিন দুই বেলা বসতাম। গোটা সাতক্ষীরায় তখন আর কোনো এমবিবিএস ডাক্তার ছিল না। প্রচুর রোগী হতো। ভালোই দিন কাটছিল।
১৯৫৪ সালে সাতক্ষীরা পৌর নির্বাচনে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। ব্যাপক ভোট কারচুপি হওয়ায় হেরে যাই। খুলনা নির্বাচন কমিশনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে মামলা করি। সে মামলার সূত্রে নির্বাচন কমিশনার প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালট বাক্স চেয়ে পাঠালেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবার ব্যালট বাক্স হাজির করতে বললেন সংশ্লিষ্ট লোকজনকে। কিন্তু তাঁরা ভোটের হিসাব মেলাতে না পেরে সেটি পুড়িয়ে ফেলেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলেন। মামলাটি তুলে নিতে তিনি আমার ওপর চাপ তৈরি করলেন। আমার বাবাও আমাকে বললেন মামলা তুলে নিতে। প্রথমে আমি রাজি হইনি। পরে বাবাকে বললাম, আমি মামলা তুলে নেব, কিন্তু আর সাতক্ষীরায় থাকব না। এরপর আমি খুলনায় গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করলাম।
একদিন ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এডিনবরায় ডিটিএমঅ্যান্ডএইচ-এ ডিগ্রি নেওয়ার একটি বিজ্ঞপ্তি দেখতে পেলাম। ভর্তির জন্য আবেদন করে নির্বাচিতও হয়ে গেলাম। বাবা আমাকে বিলেতে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করলেন। আমার বাবা আবদুল বারি খান ছিলেন সেই সময়ের এন্ট্রান্স পাস। ১৯১৪ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাস করার পর চারপাশের বহু গ্রামের মানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি চাইতেন, তাঁর চার ছেলেই শিক্ষিত হোক। মূলত বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই আমি ডাক্তারি পড়ি। আজ ভাবি, ভাগ্যিস, সেদিন নির্বাচনে পাস করতে পারিনি। কে জানে, আজ তাহলে কী হতো!
আরও পড়ুন : ‘সুচিন্তা’ যেভাবে চঞ্চল চৌধুরী হয়ে উঠলেন
১৯৫৬ সালের অক্টোবরের এক দিনে বিলেতে গিয়ে নামলাম। সেখানে একটি মজার ঘটনা ঘটল। কেএলএমএর অফিসে বসে আছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। অফিস বন্ধ করার সময় কর্মকর্তারা বললেন, ‘আপনি বসে আছেন কেন?’ উত্তরে বললাম, ‘আমার ছোট ভাই স্কটল্যান্ড থেকে এসে আমাকে নিয়ে যাবে।’ এ কথা শুনে তারা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনার ছোট ভাই স্কটল্যান্ড থেকে এসে আপনাকে নিয়ে যাবে? কেন? আপনি নিজেই তো ট্রেনে করে যেতে পারেন।’ আমি বললাম, ‘আমার কাছে পাউন্ড নেই।’ তারা বলল, ‘আপনার কাছে তো ট্রাভেলার্স চেক আছে। সেটা ভাঙান।’
আমি ট্রাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে ট্রেন ধরার জন্য কিংক্রস স্টেশনে গেলাম। টিকিট কেটে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় একটি কৃশকায় লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার স্যুটকেস ট্রেনে তুলে দিলেন। জানতে পারলাম, তিনি বারবাডোজ থেকে এসে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। পড়াশোনার খরচ চালাতে পোর্টারের কাজ করছেন।
আমি তো অবাক। আমার স্যুটকেস আমি বইতে পারছি না, অথচ একজন পিএইচডির ছাত্র এই কাজ করছেন।
এডিনবরায় ডিপ্লোমা অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনের ওপর এক বছরের কোর্সটা করলাম। এরপর নর্দান জেনারেল হাসপাতালে শিশু-চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণের জন্য অধ্যাপক ফরফারের অধীনে কাজ করতে শুরু করলাম। এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষ করে চলে এলাম লন্ডনে। সেখানকার স্কুল অব মেডিসিন, লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা অব চাইল্ড হেলথ ডিগ্রি নিলাম। শিশু-চিকিৎসার ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল গভীর। আমি দেখেছি, শিশু-চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ দেশে শূন্যতা ব্যাপক। আমাদের দেশে শিশু-চিকিৎসক বলতে আদতে বলে কিছু ছিল না।
অনেকেই আমাকে বলতে শুরু করল, এবার দেশে ফিরে যাও। তাদের কথায় কান না দিয়ে আমি এডিনবরায় ফিরে এসে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম এমআরসিপি পরীক্ষার জন্য। এর জন্য আমি দুটি কোর্স করলাম। এমআরসিপি পরীক্ষায় পাস করলাম ১৯৬২ সালে, এডিনবরার রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে।
আরও পড়ুন : ৩৮ বছরের কর্মজীবন, ৬২ বছর বয়সে মাস্টার্স পাস
এমআরসিপি পরীক্ষায় পাস করার পর হাসপাতালে আমার বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেন, ‘তিনি ডা. এম আর খান। তিনি মাত্রই এমআরসিপি পাস করেছেন।’ তাঁর কথা শুনে অল্প কিছু মানুষ হাততালি দিলেন। এবার সঞ্চালক বললেন, ডা. এম আর খান সম্প্রতি পরীক্ষায় পাস করে ব্রিটিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। উপস্থিত সবাই তখন আমার উদ্দেশে খুব জোরে হাততালি দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম, এমআরসিপি পাস করার চেয়ে ব্রিটিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের গুরুত্ব এ দেশে অনেক বেশি। তাঁদের অনেকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। যা হোক, এর পর এডিনবরার বিরাট এক হাসপাতালে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করতে শুরু করলাম।
১৯৬৩ সালের গোড়ায় পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে এসে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দিই। আমার বিষয় শিশুচিকিৎসা বলে ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি আমি চলে যাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। সেখানে শিশু বিভাগ চালু করে ডাক্তার নিয়োগ করি। মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ কে খান এ ব্যাপারে আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমি না থাকলে শিশু বিভাগ চালু হবে না। আমার কাজে সাহায্য করার জন্য তিনি একজন ডাক্তার এবং মেডিসিন বিভাগ থেকে চারটা বেড দিয়ে দিলেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের এই হলো সূচনা।
আমাদের দেশে তো আগে শিশুদের টিকা বলেই কিছু ছিল না। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে আমার ধানমন্ডির বাসায় প্রথমবারের মতো একটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়। সেটি ছিল কোয়াট্রোভিভেলন। পোলিও, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি ও টিটেনাসের একটি সমন্বিত টিকা। দেওয়া হতো ইনজেকশনের মাধ্যমে। টিকাটি তৈরি করেছিল হোয়েকস্ট নামে এক কোম্পানি। আরও পরে বাংলাদেশ সরকার টিকা দেওয়ার কর্মসূচি চালু করে। এটি দেশের শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনে। বাংলাদেশ তো এখন পোলিওমুক্ত একটি দেশ।
আরও পড়ুন : ‘অভিনেত্রী ও মা’ দুই জায়গাতেই সফল ছিলেন শর্মি
রাজশাহীতে আমি কাজ করেছি পুরো পাঁচ বছর। এর পর ১৯৬৯ সালে চলে আসি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে শিশু বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। ১৯৭১ সালে বদলি হয়ে আসি তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। দেশে তখন প্রফেসর অব পেডিয়াট্রিকস বা শিশুরোগবিষয়ক অধ্যাপকের পদ একটাই ছিল। এর পরের বছর নিই পিজি হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালকের দায়িত্ব। পরিচালকের পদে ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। পিজি হাসপাতালে থাকাকালে সেখানে শিশুরোগসহ অন্যান্য কোর্স চালু করি। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে মিলে তৈরি করি স্নাতকোত্তর পর্বের পাঠ্যক্রম।
পিজি ও ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বাংলাদেশের নানা হাসপাতালে এ পর্যন্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আবার পিজি হাসপাতালে এসে শিশুরোগ-সংক্রান্ত অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করি। পাশাপাশি শিশুচিকিৎসার ওপর বিভিন্ন কোর্সও পরিচালনা করি।
সরকারি চাকরি থেকে আমি অবসর নিয়েছি ১ আগস্ট ১৯৮৮। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি, কিন্তু আমার পথচলা থেমে থাকেনি। শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালু করেছি। দেশের পাঁচটি জেলার ১২টি এলাকায় এর শাখা রয়েছে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি বিচিত্র কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তো যুক্ত রয়েছিই।
আমার প্রতিটি দিন কাটে অসম্ভব ব্যস্ততায়। এখনো ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের বাড়িতে সপ্তাহে পাঁচ দিন এক বেলা রোগী দেখছি। আমার এই কাজের জন্য কত মানুষেরই না ভালোবাসা পেয়েছি। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি ক্লান্ত বোধ করি কি না। আমি বলি, ক্লান্তির অবকাশ কোথায়? কাজই জীবন, কাজই আনন্দ, কাজই সাফল্য।
এম আর খান
প্রথিতযশা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; জাতীয় অধ্যাপক, সম্মানসূচক ডক্টরেট ও একুশে পদক স্বীকৃতিতে সম্মানিত
লেখা: প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের নায়কেরা' বই থেকে সংগৃহীত