রাউফুন বসুনিয়া একটি নাম, একটি ইতিহাস
ভাষা আন্দোলন থেকে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা স্বাধীকার আন্দোলন। স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনেই রক্ত ঝড়াতে দেখা গেছে এদেশের তরুণ ছাত্র সমাজকে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্ন সময়ে দেশের মসনদে আসীন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও। রফিক, জব্বার, শহীদ আসাদের মতো প্রাণ দিয়েছেন এদেশের অসংখ্য ত্যাগী ছাত্র নেতৃত্ব।
যুগ যুগ ধরে দেশের কল্যানে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আসা জীবন উৎসর্গকারী এসব ছাত্রদের মধ্যে একটি উজ্জল নাম রাউফুন বসুনিয়া।
বসুনিয়া কুড়িগ্রাম জেলার সন্তান। জেলার রাজারহাট উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ফিরোজা বেগম। বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলাম। পাইকপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর পাঙ্গারাণী লক্ষ্মীপ্রিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কারমাইকেল কলেজ থেকে। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ হওয়ার সময় স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু জীবনের এই সাধারণ তথ্যপত্র থেকে নয়, রাউফুন বসুনিয়ার অসাধারণত্ব ফুটে ওঠে তার সমকালীন প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে।
আরও পড়ুন: দেশে দেশে ভাষার লড়াই ও ৫২’র ভাষা আন্দোলন
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির রাত ছিল অন্য সব রাতের মতোই সাধারণ। পরদিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলন দিবস উপলক্ষে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি। এ দিবসের কর্মসূচির প্রচারাভিযান উপলক্ষে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে সংগ্রাম পরিষদের একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল, মুহসীন হল হয়ে জহুরুল হক ও এফ রহমান হলের মাঝখানের সড়কে ওঠে।
মিছিলটি এফ রহমান হলে অবস্থানরত নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ ও মুহসীন হলে অবস্থানরত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়। এ সময় নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের ক্যাডারদের কাঁটা রাইফেলের গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়া। বসুনিয়াকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যান সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতা মোস্তফা ফারুক ও ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও বসুনিয়ার বন্ধু মাসুদ রানা।
সেখানে ডাক্তাররা জানান, তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বসুনিয়া হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করে। ক্যাম্পাস ছেয়ে যায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নতুন স্লোগানে, ‘সময়ের সাহসী সন্তানেরা বারবার আসে, বারবার যুদ্ধে যায়’। ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণাধীন সংগ্রামী ছাত্রজোটও যুগপৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরে অর্ধদিবস হরতাল ঘোষণা করে।
বসুনিয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের মুল গেইটের পাশে তাঁর তোরণ ও ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।
রাউফুন বসুনিয়াকে তাঁর জন্মস্থান পাইকপাড়াতে পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়। তাঁর মা এ ঘটনার পর প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, প্রতিদিনই বসুনিয়ার কবরের পাশে এসে দাঁড়াতেন আর অঝোরে কাঁদতেন। দুই দশকেরও বেশি সময় এভাবে পাড়ি দেওয়ার পর ২০০৮ সালের জুলাইয়ে মারা যান বসুনিয়ার বাবা, এর কয়েক মাস বাদেই মারা যান মা।