ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন-ইসলামী ছাত্রসংঘকে যেভাবে দেখতেন হুমায়ূন
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২০, ০৬:২৩ PM , আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২০, ০৭:৫৮ PM
আজ ১৩ নভেম্বর। বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র হুমায়ূন আহমেদের ৭২তম জন্মবার্ষিকী। চলে যাওয়ার ৮ বছর পরও পাঠকপ্রিয়তা ও গুণ-মানে প্রাসঙ্গিক হুমায়ূন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হুমায়ূন আহমেদ— এ দুইয়ের রসায়ন নিয়ে হুমায়ূন নিজে যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন অগণিত তরুণ-বুড়ো সাহিত্যিক-সাংবাদিকরাও। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিকে অপছন্দ করতেন তিনি। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশেষ সম্পাদনা—
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সখ্যতা শুরু ১৯৬৮ সাল থেকে। এ বছরই তিনি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড প্রতিষ্ঠানের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। সিট বরাদ্দ হয় ফজলুল হক মুসলিম হলে। কিন্তু বরাবরই তার হলটি অপছন্দের ছিল। সুযোগ খুঁজতে থাকেন অন্য হলের ওঠার। পেয়েও যান। নতুন বরাদ্দ হয় হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল। হলটি তখন সদ্যই (১৯৬৭) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে হলের ভেতর-বাহিরের চাকচিক্যতা, অন্যদিকে নতুন লিফট— দুইয়ে মিলে শুরুটা বেশ ভালোই হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের; যদিও এই ভালো পুরো হল জীবনে ছিল না।
উপন্যাস ‘মাতাল হাওয়া’য় লিখেছেন, ‘‘মুহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে রসায়ন বিভাগের অতি নিরীহ একজন ছাত্র বাস করত। এসএসসি ও এইচএসসিতে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বলে তাকে একটি সিঙ্গেল রুম দেওয়া হয়েছিল। এই বেচারা এনএসএফ নেতাদের ভয়ে অস্থির থাকত। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই এনএসএফের নেতারা তার রুমে ঢুকে সব তছনছ করে দিল। তোশক জ্বালিয়ে দিল এবং বেচারার নিজের টাকায় কেনা মরিসন অ্যান্ড বয়েডের লেখা ‘অর্গানিক কেমিস্ট্রি’ বইটাও ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলল। বই কুটিকুটি করার বিষয়টি উল্লেখ করার গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ, বইটি সে অনেক দাম দিয়ে স্কলারশিপের টাকায় কিনেছে। তার একটাই বই। ক্যামিস্ট্রির অন্য বইগুলো সে লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ত। নতুন করে আরেকটা তোশক কেনার টাকা তার ছিল না। খাটে পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে ঘুমানো ছাড়া তার কোনো পথ রইল না। সন্ত্রাসের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগে মাথা নিচু করে থাকতেন। এখনো থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব হয়তো ছিল না, সাহসের অভাব ছিল।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়া অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিকে অপছন্দ করতেন হুমায়ূন। এক বর্ণনাও লিখেছেন-
ছাত্র ইউনিয়ন: যারা এই দলে ধরেই নেওয়া হতো, তাদের মধ্যে মেয়েলিভাব আছে। তারা পড়ুয়া টাইপ। রবীন্দ্রনাথ তাদের গুরুদেব। এরা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করে। গানবাজনা, মঞ্চনাটক জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিতে উপস্থিতি থাকে। এদের ভাষা শুদ্ধ। নদীয়া শান্তিপুর স্টাইল। যে-কোন বিপদে-আপদে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে এরা পারদর্শী। মিছিলের সময় পালানোর কথা বিবেচনায় রেখে এরা পেছন দিকে থাকে। এই দলটির আবার দুই ভাগ। মতিয়া গ্রুপ, মেনন গ্রুপ। একদলের উপর চীনের বাতাস বয়, আরেক দলের উপর রাশিয়ার বাতাস বয়।
ছাত্রলীগ: পড়াশোনায় মিডিওকার এবং বডি বিল্ডাররা এই দলে। এই সময়ে তাদের প্রধান কাজ এনএসএফ-এর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সামনে তারা খানিকটা হীনমন্যতায় ভোগে। মারদাঙ্গায় এবং হলের ক্যান্টিনের খাবার বাকিতে খাওয়ায় এরা বিশেষ পারদর্শী।
ইসলামী ছাত্রসংঘ: মওদুদীর বই বিলিয়ে ‘দীনের দাওয়াত দেয়া’ এদের অনেক কাজের একটি। পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করা, মসজিদ ভিত্তিক সংগঠন করা এদের কাজ। দল হিসেবে এরা বেশ সংঘঠিত। কথাবার্তা মার্জিত। অনেকের বেশ ভালো পড়াশোনা আছে।
এনএসএফ: প্রধান এবং একমাত্র কাজ সরকারি ছাতার নিচে থেকে গুণ্ডামি করা। সরকার এদের ওপর খুশি। কারণ, এদের কারণে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না।
হুমায়ূন লিখেছেন, ‘এই জাতীয় কোন সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার প্রশ্নই আসে না। আমি পড়াশোনা নিয়ে থাকি। বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ছয় আনা খরচ করে দুটা গরম গরম সিঙ্গারা এবং এককাপ চা খেয়ে শরিফ মিয়ার কেন্টিনের সঙ্গে লাগোয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে যাই। গল্প-উপন্যাস পড়ি।’
হলে নিজের অবস্থান করে নিতে হুমায়ূন আহমেদ একবার এনএসএফ-এর এক গুন্ডাকে বাগে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে সবাই তাকে ভয় ও সমীহ করা শুরু করে। এছাড়াও ‘হাত দেখে ভবিষ্যৎ বলা’ তার আরেকটি কৌশল ছিল। হুমায়ূন লিখেছেন, ‘পরিস্থতি বৈরী হলে শামুক তার নিজের খোলসের মধ্যে ঢুকে যায়। আমার কাছে পরিস্থিতি বৈরী মনে হলো। চলমান উত্তপ্ত ছাত্র রাজনীতির বাইরে নিজেকে নিয়ে গেলাম। বিচিত্র এক খোলস তৈরী করলাম। সেই খোলস ম্যাজিকের খোলস, চক্র করে ভূত নামানোর খোলস। তখন হাত দেখাও শুরু করলাম। হাত দেখে গড়গড় করে নানান কথা বলি। যা বলি তাই না-কি মিলে যায়।
‘আমাকে এখন আর কেউ ঘাঁটায় না। আমি মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে মানুষের মাথার খুলি এনে চিকন সুতা দিয়ে আমার ঘরে এক কোনায় ঝুলিয়ে দিলাম। দেওয়ালের রঙ সাদা, সুতার রঙও সাদা। ব্লাক আর্টের মতো তৈরী হলো। হঠাৎ দেখলে মনে হতো মানুষের মাথার একটা খুলি শূন্যে ভাসছে। বেশ কয়েকজন এই দৃশ্য দেখে ছুটে পালায়।’
হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফা ও আনিস সাবেত ছিলেন হল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে সময়ই তারা বুদ্ধিভিত্তিক সাহিত্যসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করতেন। মজার ব্যাপার ছিল তাঁরা একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কখনোই বিয়ে করবেন না; চিরকুমার থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীতে একমাত্র আহমদ ছফা ব্যতিত সবাই প্রতিজ্ঞা ভেঙেছিলেন।
ভালো ফলাফল করায় সিঙ্গেল রুম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদকে। যেটাকে বেশ উপভোগ করেছে হুমায়ূন। বলেছেন, ‘মহসীন হলে আমার সিঙ্গেল সিটের রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি জানালার দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। জানালা বিশাল। শীতের হাওয়া আসছে। গায়ে চাদর দিয়েছি। চাদরের ওম ওম উষ্ণতা। আমার হাতে টমাস হার্ডির লেখা বই এ পেয়ার অব ব্লু আইজ। মূল ইংরেজি বই না, অনুবাদ। আমি মুগ্ধ হয়ে প্রেমের উপন্যাস পড়ছি।’
হুমায়ূন আহমেদ রসায়ন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে পিএইচডি করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এভাবেই মুহসীন হলের ছাত্র থেকে শিক্ষক এবং শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর হয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে আবির্ভূত হনে হুমায়ূন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তো বটেই, হল জীবনকেও গভীরভাবে মিস করতে হুমায়ূন আহমেদ। আমার আপন আঁধার বইয়ে লিখেছিলেন, ‘দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার হয়ে গেল। আনিস সাবেত মারা গেল ক্যানসারে। বন্ধুবান্ধবরা আজ কে কোথায় জানিও না। মাঝে মাঝে হলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মনে হয়—আবার সবাইকে খবর দেয়া যায় না? খেতে খেতে আমরা পুরোনো দিনের গল্প করব...।’