বাংলার রুমির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ আহমদুল হক (বায়ে)
সৈয়দ আহমদুল হক (বায়ে)

আজ ৫ সেপ্টেম্বর। নয় বছর পূর্বে আজকের এই দিনে আমাদের ছেড়ে যান একজন অনন্যসাধারণ ও কীর্তিবান ব্যক্তিত্ব। অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী সেই বিরল প্রতিভার মানুষটি হলেন সৈয়দ আহমদুল হক (১৯১৮-২০১১ খ্রি.); যাঁকে ‘বাংলার রুমি’ নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে সুফিতাত্ত্বিক গবেষণা ও মানবতাবাদী দর্শন চর্চায় তিনি অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছেন। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ভালোবাসার রত্নপাথর ছিলেন তিনি। মানুষকে ভালোবাসা ও সম্মান করার মধ্য দিয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সুফিবাদের চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবিক সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

তিনি রুমি ও তাঁর মসনভিকে কেন্দ্র করে এক নজিরবিহীন সাহিত্য-ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন। কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা ও খোদা-প্রদত্ত অলৌকিক জ্ঞান এক্ষেত্রে তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর করেছে। বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃতের মতো ভাষায় তাঁর বিস্ময়কর বিচরণ ছিল। সাহিত্য চর্চা ও রচনার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ ঝোঁক; বিশ্বসাহিত্যের নানা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। পারিবারিক ঐতিহ্য, ইসলামি মূল্যবোধ, নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি, উদার ও সহনশীল সংস্কৃতি ছিল তাঁর জীবনের মূল্যবান পাথেয়।

বাংলার রুমি ছিলেন ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র, পেশাগত জীবনে একজন কর্মনিষ্ঠ ও সফল সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং অবসর জীবনে জ্ঞান ও গবেষণায় নিয়োজিত একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক হিসেবে ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরি হতে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতি ও স্থায়ী উন্নয়নকল্পে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী হয়েও তিনি অন্যান্য সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শিতা অর্জন করেন। একই সাথে তুলনামূলক সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের বিপুল স্বাদ আস্বাদন করা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ইসলাম, কুরআন-হাদিস, সুফিবাদ, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি এবং নানা ক্ষেত্রে বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিদের উপর ছিল তাঁর অগাধ অধ্যয়ন ও চর্চা। তাই আমরা তাঁকে দেখি, দেশের অর্থনীতির শক্ত ভিত প্রদান করতে তিনি কর্মময় জীবনে যেমন সচেষ্ট ছিলেন, অন্যদিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা ও মানুষের আত্মিক সংশোধন এবং সমাজ সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য এবং এ দিক বিবেচনায় তাঁর মতো কীর্তিবান আমাদের দেশে খুব কমই রয়েছেন।

বাংলার রুমি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত একজন সাধক। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ তাঁর প্রাত্যহিক জীবনাচার, সকল কার্যকলাপ এবং সামগ্রিক নীতি ও দর্শনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা এই জীবনবোধকে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন। এরই ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, উঁচু-নীচু নির্ণয়, কালো-সাদার প্রভেদ, ধনী-গরিবের পার্থক্য ও জাত-ধর্মের বিতর্ককে তিনি দূর করতে চেয়েছেন। মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবে সম্মান দিয়েছেন। সৃষ্টির সেরা গর্ব হিসেবে তিনি মানুষকে মূল্যায়ন করেছেন। এভাবে তিনি একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন, যেই সমাজ সকল মানুষের সম্মিলিত বন্ধন ও সহাবস্থানে শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ কাজে তিনি তাঁর পারিবারিক শিক্ষা, সুফিতাত্ত্বিক নিদর্শন, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শিক দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী সমাজ বিনির্মাণে বাংলার রুমি বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। মোটা দাগে তাঁর প্রয়াসসমূহ তিন ধরনের ছিল। প্রথমত, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, কথাবার্তা ও উপদেশাবলির মাধ্যমে মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনা। দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধ লেখা, সাহিত্য রচনা ও গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে মানুষকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন করা। তৃতীয়, জনসমাগম ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা; ‘আল্লামা রুমি সোসাইটি’ এ বিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ সংযোজন। তাঁর জীবনাবসানের পরেও এ সোসাইটি মানবসমাজে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

বাংলার রুমি ছিলেন বাংলাদেশে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল সারথী। মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমে তিনি এই সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবনের সাধনাই হলো মানবকল্যাণ ও প্রেমের। তাঁর জীবন-দর্শনের মূল কথাই ছিল প্রেম। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিই তাঁর এই ভালোবাসা। তাঁর এই প্রেমই হলো স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মিলনের সেতুবন্ধন। এই প্রেমই পারে অহিংস সমাজ গড়তে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সৃষ্টি করতে এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বাঁধনকে মজবুত করতে। তাই বাঙালি সমাজে তিনি গেয়ে গেছেন ঐশী প্রেমের জয়গান; যেন মানুষ সত্যিকার অর্থে সফল হতে পারে। মানুষের প্রেমপূর্ণ এই শান্তিময়তাই এদেশকে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, এ ছিল তাঁর বিশ্বাস।

বাংলার রুমি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর এই বিশ্বাস ও আদর্শ রয়ে গেছে। আমরা স্বপ্ন দেখি একটি শান্তিময়, সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু সমাজের; বাংলার রুমির বিশ্বাস ও আদর্শকে ধারণ করার মাধ্যমে সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি।

বাংলার রুমির নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আমরা মহান প্রভুর কাছে তাঁর জন্য জান্নাতে সর্বোত্তম আবাসের প্রার্থনা করি।

লেখক ও গবেষক: অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ