একজন ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী
- তানভীর আহম্মেদ, গবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১২:৩৭ AM , আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:৪৭ AM
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যাবস্থা সবাইকেই এতটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে দেয় যে পুঁজিপতি হওয়ার লোভ স্বীয়-স্বার্থকে প্রচণ্ড রকমের স্বার্থবাদী করে তোলে। এর ফলে অপরের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া যেন বিরাট বিলাসিতা হয়ে যায়। কিন্তু সবাই পুঁজির স্রোতে গাঁ ভাসায় না, এমনও অনেক আছে যারা নিজেকে বিলিয়ে দেয় অপরের কল্যাণে, নিজের সুখ বলতে জনগণের সুখকেই বুঝেন, প্রয়োজনে নিজেকে অন্যের জন্য ত্যাগ করেও দিতেন পারেন। এদের মহানুভবতা, মহৎ চিন্তা-চেতনা, আদর্শ কখনো পুঁজির মোহে হার মানে না। এদেরই একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
স্বাধীন বাংলাদেশের দেশসেরা একজন চিকিৎসা সার্জন হতে পারতেন, যুক্তরাজ্যে বিলাস বহুল জীবন ধারণ করতে পারতেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারতেন, পারতেন মন্ত্রী, কোটি টাকার বাড়ি, গাড়ি কিংবা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক হতে। কিন্তু কোটিপতি আয়েশি জীবন তিনি বেছে নেননি। বেছে নেননি দুর্নীতি, কালোবাজারি কিংবা লুটপাটের আশ্রয়। বরং তিনি একটি স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দেশের চিকিৎসা সেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, নারীর ক্ষমতায়নের অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছেন। গরীব-অসহায়দের জন্য চিরজীবন রাজনীতির মাঠে লড়ে গেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। বকশী বাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই এফআরসিএস পরীক্ষা। কেবল দুটো পরীক্ষা দিলেই চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু সে পরীক্ষার লোভ তাঁকে স্পর্শ করলো না। পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করেই তিনি হয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সৈনিক। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিলেন লন্ডনে থাকা অবস্থায়ই। হানাদার বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে পাকিস্তানি পাসপোর্ট আগুনে পুড়িয়ে নাগরিকতা বর্জন করেছেন। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ব্রিটেনে বসবাসরত এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসককে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। যার সভাপতি ছিলেন ডা. এ এইচ সায়েদুর রহমান এবং তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যোগ দিতে ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে অ্যাসোশিয়েশন থেকেই ডা. এম এ মোবিনকে (কার্ডিয়াক সার্জন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে এফআরসিএস পড়তেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস) সাথে নিয়ে ভারতের রুট পারমিট জোগাড় করে দিল্লীর বিমানে চড়ে ভারতে আসেন। এরপর তারা অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর) সহায়তায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মেঘালয়ে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেন। এই হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন সেনাবাহিনীর ডাক্তার সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক)। যুদ্ধক্ষেত্রে বহু হতাহত যোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে এই ফিল্ড হাসপাতাল থেকে। ছন ও বাঁশের তৈরি হাসপাতালটিতে মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহতদের জরুরি অপারেশনও করা হতো। সেসময় প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তাঁর বোন সাঈদা কামাল।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুনঃস্থাপিত হয়। পরবর্তিতে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার জন্য ‘চল গ্রামে যাই’ এই স্লোগান ও উদ্দেশ্য নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয়। তখন নামকরণ করা হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু এ নামকরণের পিছনেও ইতিহাস আছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল হিসেবে নাম হলে স্বাধীন দেশে ‘বাংলাদেশ’ নামটা কেমন জানি সরকারি সরকারি হয়ে যায়। এ কারণে খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমনানও চাননি বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপতাল নামটা থাকুক। এ বিষয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করেন এবং অনেক তর্ক-বিতর্কের পর দুইজনে আলাদাভাবে তিনটি নাম পছন্দ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামের তালিকায় থাকা দ্বিতীয় নামটি গণস্বাস্থ্য আসতেই বঙ্গবন্ধু এই নামটি পছন্দ করে ফেলেন এবং এই নামে নামকরণ কথা বলা হয়। ডা. জাফরুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর কথা রাখলেন এবং বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের নাম পরিবর্তন হয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হয়ে যায়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের তৈরি হওয়া প্রথম হাসপাতাল। বঙ্গবন্ধু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে শুধু চিকিৎসা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চাননি, চেয়েছেন একটি দেশ গড়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তিনি বলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শুধু চিকিৎসা সেবা দিলে হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হলে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়েই কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’ আজকের গণস্বাস্থ্য বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের পূর্ণরূপ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শুধু হাসপাতালের মধ্যেই এখন সীমাবদ্ধ নেই; স্বাস্থ্য শিক্ষা, কৃষি সব অঙ্গনেই আছে অভূতপূর্ব সাফল্য। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একটি অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন তিনি, যেখানে রয়েছে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানের জন্য, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের জন্য, প্রতিবন্ধী এবং উপজাতি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, বিনা বেতনে অধ্যয়ন, টিউশন ফি ছাড়সহ নানান সুযোগ। এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মেডিকেলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়, ধূমপায়ী, নেশাগ্রস্থদের ভর্তির কোন সুযোগ নেই। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের বই পড়ার জন্য পয়সা খরচ করে বই কিনে নিতে হয়, নিজস্ব লাইব্রেরিতে বই পড়ার জন্য সবসময় উদ্বদ্ধ করা হয়। সাঁতার, মোটরসাইকেল চালানো শিখে নিতে হয়। কৃষি ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করতে গণস্বাস্থ্যের বিভিন্ন পতিত জমিতে চাষবাস করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি সম্পৃক্ত সাবজেক্ট পড়ানো হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্স নামক প্রাণী চিকিৎসা এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো অতিব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের বিষয়ের অধ্যয়ন করার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেসরকারি এবং ব্যতিক্রমী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বেশ সুখ্যাতি আছে। খেলাধুলায় গণবিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য, ২০১৯ বঙ্গবন্ধু স্পোর্টস চ্যাম্প ফুটবলে নারী এবং পুরুষ দুটো দলই চ্যাম্পিয়ন, সেবারের সাতটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চারটিতেই তারা জয়লাভ করে, ২০১৮ তে ফারাজ গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন এবং এবারের ২০২০ বঙ্গবন্ধু স্পোর্টস চ্যাম্পেও মেয়েরা দু'টি খেলায় ফাইনালে পৌঁছে গেছে। এরপর করোনার জন্য খেলা বন্ধ হয়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্টিল, বেকারি, ছাপাখানাসহ বিভিন্ন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
নারীর ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভূমিকা অসাধারণ। ১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশে শিক্ষা ও নারীনীতি প্রণয়নে। প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী ‘পারে না’ বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথমে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদেরও কাজ করে জীবন-যাপন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানে ১০ জনের মতো হিজড়া কর্মরত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অংশ নিলে ২৫% টিউশন ফি রেয়াতের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। নারী শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে এবং বিভিন্ন বড় বড় টুর্নামেন্ট জয় করছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনয়াক সাবিনা খাতুনও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ১৯৮০ সালে জিয়ার গড়া প্রথম জাতীয় মহিলা উন্নয়ন কমিটির দুই পুরুষ সদস্যের একজন হিসেবে প্রাথমিকে ৫০ শতাংশ মহিলা শিক্ষক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ ছাত্রী নেয়ার সুযোগ করেছিলেন, যা কার্যকর হয়েছিল এরশাদ আমলে। জিয়াউর রহমানের আমলে পুলিশে মহিলা নিয়োগ দেয়া শুরু হলে দেশের প্রথম দুই নারী পুলিশ- হিসেবে নিয়োগ পান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী হোসনে আরা ও চামেলী বেগম। বর্তমানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মোট কর্মী সংখ্যা প্রায় ২,৫০০। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ নারী।
স্বাধীন বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ ছিল বাজারে। কিছু তারা উৎপাদন করতেন, অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতেন। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায়, চার পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে উপেক্ষা করেছিলেন এরশাদের প্রস্তাব। তাঁর পরামর্শেই এরশাদ আমলে পোস্টার, বিলবোর্ড বাংলায় লেখা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন, উপজেলাব্যবস্থা ও সফল জাতীয় ওষুধনীতি ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি করেছিলেন। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়। দেশীয় ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা সেই বৈপ্লবিক ওষুধ নীতিরই সুফল। এখন ১৬-১৭ কোটি মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশও।
১৯৮১ সালে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। অন্য সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে গণস্বাস্থ্য উৎপাদিত ওষুধের দাম প্রায় অর্ধেক। যেমন কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্যে অপরিহার্য ইনজেকশন ‘হ্যাপারিন’। বাজারে দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিতটির দাম ২০০ টাকা। সারা পৃথিবীতে কোলেস্টেরল কমানোর জন্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ ‘অ্যাট্রোভাসটাটিন’। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিত একটি ট্যাবলেটের দাম ৭ টাকা, অন্যদের উৎপাদিতটির দাম ১১ টাকা।
সাভারের পর ১৯৯৫ সালে ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল তৈরি করা হয়। এছাড়া কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে ৫০টির মতো। সেখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, প্যারামেডিক উপস্থিত থাকেন। ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। ভারতেও এত বড় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম।
ডা. জাফরুল্লাহ নিজেকে প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে গড়ো তোলেননি। তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের মালিক সাধারণ জনগণ কেউ মালিক হবে না এই প্রতিষ্ঠনের। তাই তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন ট্রাস্টি। প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দশ বছর আগে। সম্প্রতি কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মালিকানাধীন’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সঠিক তথ্যটি হলো, ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক নন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। মানুষের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর যে অধিকার, ডা. জাফরুল্লাহর অধিকার তার চেয়ে বেশি নয়।
তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়।
গ্লোবাল প্যারামেডিক কনসেপ্ট ও ট্রেইন্ড প্যারামেডিক দিয়ে মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সংক্রান্ত তার পেপারটি বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট মূল আর্টিকেল হিসেবে ছাপা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মূল পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের একটা চ্যাপ্টার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখতেন অনেক বছর ধরে। দেশে-বিদেশে তার লেখা বই ও পেপারের সংখ্যা প্রচুর। তাঁর পরামর্শে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের পক্ষে পাসপোর্ট ইস্যু করে বিলেতের এক লাখ বাঙালির কাছ থেকে আবু সাইয়িদ চৌধুরী ১০ লাখ পাউন্ড চাঁদা সংগ্রহ করেছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ডা. জাফরুল্লাহ জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে তোলায় সক্রিয় হয়েছেন শুধু দেশের জনগণকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
তাঁর দুটে কিডনিই অকেজো, সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। এই জীর্ণ শরীর নিয়েও তিনি জনগণের মুক্তির জন্য লড়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি করোনা মহামারির কারণে দেশের ক্রান্তিলগ্নে আবারো নায়কের ভূমিকায় হাজির হয়েছিলেন, এবারও তিনি স্বাধীনতার সে রণাঙ্গনের মতো ফেরেশতার মতো উত্তীর্ণ হলেন। করোনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একজন ২০-২৫ বছরের যুবকের মতো তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন, সংবাদ সম্মেলন করছেন। যেখানে অসুস্থ ও বয়স্ক লোকদের করোনার জন্য ঘরে থাকতে হয়। সেখানে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন জীবনের কোন পরোয়া করছেন না। সম্প্রতি এটিএন নিউজে ডা. মনিষার করোনার কিট নিয়ে কোন রাজনীতি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আমি মানুষরে রাজনীতি করি কোন চাটুকারীর রাজনীতি কিংবা ক্ষমতার রাজনীতি করি না। কিটের অনুমোদন নিয়েও তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার ৪৮ বছরের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কখনো ঘুষ দেননি দিবেও না। নীতির প্রশ্নের এক আপোষহীন যোদ্ধা তিনি।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রেমন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।
বিশেষ এক কাজে আমার বাবা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ধানমন্ডির বাসায় গেলেন। যাওয়ার পর বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানে কাজ করা অবস্থায় দুইজন ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। এদের একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং অন্যজন তাঁর মালি। পোশাক-পরিচ্ছেদ কিংবা কাজ করার ধরণ দেখে বাবা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যান। এত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, অনেক অনেক মহৎ কাজের ব্যক্তিত্ব, এত বড় মাপের একজন ব্যক্তি যিনি, তিনি এভাবে জীবন-যাপন করেন?
তারপর, বাবার মাথায় হঠাৎ ভাবনা এলো মহৎ ব্যক্তিরা এমনই হয়, মহানুভব ব্যক্তিরা অসাধারণ হয়েও সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত। ভাবানার শেষ হতে না হতেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রুমের ভিতরে যেতে বললেন, দুইজনই ভিতরে গেলেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে আসলেন সঙ্গে টোস্ট বিস্কিট। যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত একটা পরিবারও অতিথি আপ্যায়নে ফলমূলের সাথে চানাচুর, চা, বিস্কুট, কোমল পানীয় দেওয়ার চেষ্টা করে এবং এসব কাজটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য লোক দিয়ে করানো হয়, সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আকাশ-পাতাল ব্যাবধানে।