জয়নুল গ্রামের মানুষকে ভালোবেসে দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকেন
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:১৪ PM , আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ০১:৫৪ PM
আজ ২৯ ডিসেম্বর, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৫তম জন্মদিন। দেশের শিল্পকলা চর্চা ও বিকাশের পথিকৃৎ এ শিল্পী ১৯১৪ সালের এই দিনে কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গে শিল্পচর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিন এমন এক কীর্তিমান পুরুষ, যার তুলনা তিনিই। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এ শিল্পী জাতীয় অধ্যাপকও ছিলেন।
কর্মজীবনের বেশির ভাগই ব্যয় করেছেন জন্মভূমির শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণের চিন্তায়। বহু বিখ্যাত চিত্র এঁকেছেন তিনি। ১৯৪৩-এর বঙ্গদেশীয় ঐতিহাসিক দুর্ভিক্ষের দলিল হিসেবে তার আঁকা চিত্রমালা আজও এক ঐতিহাসিক অমূল্য দলিল।
তিনি একাই বড় শিল্পী হতে চাননি, স্বদেশ ভূমিতে একটি রুচিবান চারুশিল্পী সমাজের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সবাইকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। তার মনমানসে সদা জাগ্রত ছিল এক শিল্পী ও সমাজ সচেতন সংস্কারকের ভূমিকা। তাই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জয়নুল আবেদিন জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন মাটির টানে, নাড়ির টানে। স্বদেশে নিজস্ব শিল্পাঙ্গন বা শিল্প পরিবেশ আর শিল্পী সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন তার মতো করে কেউ দেখেননি। তাই ঢাকায় ফিরে শিল্পকলার বিকাশে একটি চারুকলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কালক্রমে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয়। ’৬৭ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এদেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাঙ্খায়’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ’৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ’৭৪ পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ’৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমির অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ’৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
শিল্পী জীবনে রং তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঁকেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ’৬৯ সালে তার ক্যানভাসে উঠে আসে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ’৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম নবান্ন। এ বছরেই মনপুরা নামে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের হৃদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডে পেয়েছেন ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি।
শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য্য, দারিদ্র্য ও বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর তুলিতে ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন। শিল্পকলার সুবাদে বাঙালী সংস্কৃতিকে পৌঁছে দেন বিশ্বসভায়। একইসঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত রাখেন।
মুর্তজা বশীর একজন চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তার বাবা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, জয়নুল আবেদিন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ, জেলে, জেলেনি, কিষান-কিষানি ও খেটে-খাওয়া জনগোষ্ঠী, তাদের তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের বেদনায় তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। জয়নুল আবেদিন বেশিরভাগ কাজেই, নাগরিক জীবনের চেয়ে এ-দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে চিত্রিত করেছেন। এই সাধারণ মানুষ যখন তেতাল্লিশে কলকাতায় এলেন, তখন কলকাতার নাগরিকদের কাছে বা নাগরিক সমাজে যেসব শিল্পী বসবাস করছেন, তাঁদের দু-একজন ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কাছে এঁরা অনেকটা পূতিময় আবর্জনার মতো – তাদের মাথায় উকুন, দুর্গন্ধ, তারা উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে – যার জন্যে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় বসবাসকারী শিল্পীরা কিন্তু তেমনভাবে দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রিত করেননি; জয়নুল আবেদিন করলেন।
১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকানিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরবর্তীতে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। তাঁরা হলেন- সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ’৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।