যেভাবে ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠলেন নাহিদ ইসলাম
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৫ PM , আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩০ PM
বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন নাহিদ ইসলাম। স্নাতকে তার থিসিসের বিষয় ছিল ‘কেন বাংলাদেশের কোনও ছাত্র আন্দোলনই কখনও লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।’ থিসিসের উপসংহারে তিনি ঠিক কী লিখেছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে ২৬ বছর বয়সী নাহিদ ইতিহাস বদলে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাহিদ ইসলাম। ছাত্রদের ব্যাপক বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের কাতারে চলে আসেন তিনি। আর ওই বিক্ষোভেই পতন ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের। অথচ একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হতো সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
সেই শেখ হাসিনাকেই ‘একজন রক্তচোষা ও মানসিক রোগী’ হিসেবে উল্লেখ করেন নাহিদ। গত রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দৃঢ়কণ্ঠে হাসিনা সম্পর্কে ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন নাহিদ।
অথচ কিছু দিন আগেও তিনি ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তির একজন টিউটর। এমনকি গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াতেও হয়েছে তাকে। সেই টিউটরই এখন মন্ত্রীর মর্যাদায় দেশের আইসিটি ও গণমাধ্যম উপদেষ্টা।
এই তো গেলো জুন মাসেই আরও কিছু ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে প্রবেশ করেন নাহিদ। হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানান তিনি। কারণ তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। সেই কোটার বিরুদ্ধে নামেন ছাত্ররা। তারা চান সবার জন্য সমান অধিকার।
২০১৮ সালে প্রথম কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ওই সময় সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। প্রতিবাদও থেমে যায়। এবারও ঠিক সেরকমটাই হতে পারতো।
কিন্তু আন্দোলনে নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। গত ১৬ জুলাই নিহত হন এক ছাত্রনেতা আবু সাঈদ। আর সেটাই যেন কাল হয়ে ওঠে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য। সাধারণ ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। মানুষের মনে আগুন তো জ্বলছিলই। ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, পণ্যের বাড়তি দাম এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের’ বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের সুযোগ পায় মানুষ। আর তাই দ্রুতই দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
অবশেষে, বিক্ষোভকারীরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পতনের ডাক দেয়। ৩ আগস্ট ছাত্ররা এক দফা দাবি ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাহিদ ঘোষণা করেন, ‘হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে।’ ৫ আগস্ট গণভবনের দিকে আসতে থাকে লাখো জনতা।
টাইম ম্যাগাজিনকে নাহিদ বলেন, ‘তখনও কেউ ভাবতে পারেনি শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা যাবে।’ কিন্তু অবশেষে তিনি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন। ভারতে আশ্রয় নেন। পুরো দেশের দায়িত্ব তখন ছাত্রদের হাতে। সেনাবাহিনীর সমর্থনে হঠাৎ তখন দেশ পরিচালনার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন ছাত্ররা।
হাসিনা সরকারের বিভিন্ন মামলায় জেরবার ৮৪ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ তখন নিজেই বিপর্যস্ত ছিলেন। ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। আর এখন নাহিদ ইসলামের বস। শুধু ছাত্ররা চেয়েছিল বলেই এই পদটি গ্রহণ করেছেন তিনি।
আর এখন, কে কার কাছ থেকে আদেশ নিচ্ছে জানতে চাওয়া হলে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস সব বড় বড় সিদ্ধান্তে আমাদের পরামর্শ নেন।’
মন্ত্রণালয়ের টেবিলে থাকা একটি লাল ল্যান্ডফোনের দিকে ইঙ্গিত করে নাহিদ বলেন, ‘ভিআইপি ফোন’।
তিনি বলেন, ‘কীভাবে এটি ব্যবহার করবো তা জানি না। তবে আমি ড. ইউনূসকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করি।’
গত কয়েক সপ্তাহে যা কিছু ঘটেছে তা নিয়ে যদি নাহিদ বিভ্রান্তও থাকেন, তার শান্ত আচরণে তা প্রকাশ পায় না।
এখন তার চেয়ে বয়সে বড় ব্যক্তিগত সচিব তার ঘরে যাতায়াত করছেন, সই করার জন্য নথিপত্র নিয়ে আসছেন। দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি।
তবে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক নাহিদ সবসময়ই বিগত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রথম সপ্তাহেই সুন্দরবনে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের নিয়ে ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’ গঠন করেন।
ওই বছরও ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিতে অনেকটাই অপরিণত ছিলেন নাহিদ। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সামিনা লুথফা বলেছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর, ছাত্ররা যখন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা করেন, তখনও অস্বাভাবিকভাবে নার্ভাস দেখেছিলাম নাহিদকে। তখনও তিনি খুবই তরুণ। আর তার ওপর বিশাল দায়িত্ব।
কারণ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। নতুন বাংলাদেশে, সবাই ছাত্রদের কাছ থেকে কেবল সেরাটাই আশা করছে। এতদিন যারা ‘স্বৈরশাসকের’ হাত থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করেছে; কিন্তু কিছু করতে পারেনি, তারাও এখন প্রকাশ্যে বলার সাহস পাচ্ছেন। কিন্তু সব কিছু পাওয়ার আশাটাও খুব দ্রুতই করছেন তারা। অভিযোগের পর অভিযোগ আসছে। সুপারিশের জন্য বারবার ফোন আসছে। সবাই তাদের চাওয়া-পাওয়া আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানাচ্ছেন।
অথচ কিছু দিন আগেও কেউ চিনতো না নাহিদকে। এই বছরের জুলাইয়ে তিনি প্রথম জনগণের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। দেশের তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থা তাকে অপহরণ করেছিল। নির্যাতন করেছিল।
সরকার সমালোচকদের গুম করার জন্য কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনীর ৩০ জন সাদা পোশাকধারী কর্মকর্তা এক রাতে বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপনে থাকার সময় তাকে তুলে নিয়ে যায়। তখন তারা তাকে বলেছিল, ‘পৃথিবী তোমাকে আর কখনও দেখতে পাবে না।’
গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে তারা তাকে লোহার রড দিয়ে পেটায়। তার বাহু এবং পায়ে আঘাতের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। তারা তখন নাহিদের কাছে বারবার জানতে চেয়েছিল, ‘এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা কোথা থেকে আসছে?’
পরে তাকে হত্যা না করে এক সেতুর পাশে ফেলে রেখে গিয়েছিল গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন।
টাইম ম্যাগাজিনকে নাহিদ বলেন, ‘তারা আমার কাছে আন্দোলনের নেতার নাম জানতে চাইছিল। কিন্তু আমাদের কোনও নেতা ছিল না। আর সেটাই ছিল আমাদের মূলশক্তি।’
নতুন মন্ত্রীর ভূমিকায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে পরিচালনা করছেন বলে মনে করেন নাহিদ। জোর দিয়ে বলেন, ‘এমনকি সংবাদমাধ্যমও একটি মুখ চায়। কিন্তু আন্দোলন পরিচালনা ছিল দলীয় প্রচেষ্টা। আমিই এই আন্দোলনের একমাত্র নেতা নই। আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিল।’
নাহিদ বলেন, ‘গত ১৫ বছরে মানুষ কথা বলতে পারেনি। এখন তারা সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখনও আমাদের সামনে রয়েছে।’
নতুন সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা এখনও একটি উদ্বেগের বিষয়। এছাড়াও উৎখাতকৃত আওয়ামী লীগ আবার শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করতে পারে- সেই ভয়ও রয়েছে।
‘আর তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হলো দুর্নীতি নির্মূল করা। যতক্ষণ না নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, দেশে গণতন্ত্রের পথ পুনরুদ্ধার করা।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা এখানে কেবল অল্প সময়ের জন্য থাকবো। দুর্নীতি এবং সহিংসতা মানুষ আর চায় না। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের মনের গতি বুঝতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’