তিন বছরের কোর্সে গড়েছেন অন্তত ১০টি ভাস্কর্য, করেছেন অধ্যাপনাও

শামীম শিকদার
শামীম শিকদার  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) স্বোপার্জিত স্বাধীনতার ভাস্কর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক শামীম শিকদার মারা গেছেন। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে আজ মঙ্গলবার বিকেলে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। দুজনই লন্ডনে বসবাস করেন। আজ বুধবার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। এর আগে মরদেহ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

শামীম শিকদারের জন্ম ২২ অক্টোবর ১৯৫২। তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সিমেন্ট, ব্রোঞ্জ, কাঠ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাদা, কাগজ, স্টীল ও গ্লাস ফাইবার মাধ্যমে কাজ করেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদার তার আপন বড় ভাই।

১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমী থেকে ৩ বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন ভাস্কর্যের ওপরে। এই কোর্সটির শিক্ষক ছিলেন সিভিস্কি; যিনি একজন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ভাস্কর। লন্ডনের স্যার জন স্কুল অব কাস থেকে তিনি একটি সনদ অর্জন করেন ১৯৭৬ সালে। ১৯৯০ সালে চীনে লি ডুলি নামের একজন বিখ্যাত ভাস্করের সাথে কাজ করেন এক বছরের মতো।

আরও পড়ুন: টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতার ভাস্কর শামীম শিকদার আর নেই

শামীম ১৯৮০ সালে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব লাভ করেন। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পান ১৯৯৩ সালে। এরপর ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ভাস্কর শামীম শিকদার চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। ৮ বছর আগে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান।

১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সিতে অবস্থিত স্বোপার্জিত স্বাধীনতা শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। তার সহকারী ছিলেন শিল্পী হিমাংশু রায়। ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়।

স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন ১৯৯৪ সালে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অবস্থিত। ২০০০ সালে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য উদ্যানে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ইস্কাটনে অবস্থিত জাতীয় ভাস্কর্য গ্যালারিতে নির্মাণ করেন তিনি যেখানে আছে বিশ্বের অন্যান্য ব্যক্তিদের ভাস্কর্য, বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু ও ভয়ংকর রাজাকারদের ভাস্কর্য।

জাতীয় ভাস্কর্য গ্যালারির প্রাথমিক কাজ শেষ হওয়ার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি খুলে দেওয়া হয়েছিল দর্শনার্থীদের জন্য। শুরুতে সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য খোলা থাকত। পরে নানা কারণে এটা বন্ধ হয়ে যায়। এখন দিন-রাতই দরজা বন্ধ থাকে। তবে আগ্রহীরা গ্যালারির বাঁ পাশের দরজায় নক করলে ঢুকতে দেওয়া হয়।

‘স্ট্রাগলিং ফোর্স’ ১৯৮২ সালে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ‘একটি মধুর স্বপ্ন’ ভাস্কর্যটি চারুকলা ইনসস্টিটিউটে রাখা আছে যা ১৯৮৩ সালে নির্মিত। আশা ও উদ্দীপনার একটি পাখি নামের ভাস্কর্যটি ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত মাদার তেরেসা চ্যারিটি হাসপাতালে স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৪ সালে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তার নির্মিত ভাস্কর্য আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনোয়ার পাশায় তার নির্মিত অনেক ভাস্কর্য আছে।

তিনি ১৯৬৯ সালে লাভ করেন ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস পুরস্কার ১৯৬৯ সাল, ১৯৭০ সাল, ১৯৭৩ সাল এবং ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৩ সালে অর্জন করেন সিলভার জুবলি অ্যাডওয়ার্ড অব ফাইন আর্ট। ১৯৭৪ সালে ভাস্কর্যের ওপর প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার জিতে নেন ১৯৭৪ সালে। ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

১৯৭৫ সালে চারুকলা ইনন্সটিটিউটে তার একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে, ১৯৮২ সালে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে এবং ওই বছরই শিল্পকলা একাডেমীতে তার ভাস্কর্যের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও তার অনেক একক প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক শিল্প গ্যালারীতে। তার ভাস্কর্যের দলগত প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন স্থানে নানা সময়।

মৃত্যুর পূর্বে ৭০ বছর বয়সী শামীম হৃদ্‌রোগ, শ্বাসতন্ত্র, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় চার মাস আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি না হওয়ায় মার্চের শুরুতে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছয় দিন ধরে তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন।


সর্বশেষ সংবাদ