১৫ মে ২০২১, ১৭:১৩

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পেছনের ইতিহাস

২০ শতাব্দীর শুরুর দিকে বেথেলহাম নগরী  © সংগৃহীত

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই যেরকম তীব্র হয়ে উঠেছে, তা ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছে জাতিসংঘ। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

সর্বশেষ এই সহিংসতা শুরু হয়েছে জেরুজালেমে এক মাস ধরে চলতে থাকা তীব্র উত্তেজনার পর। কিন্তু, ইসরায়েলি আর ফিলিস্তিনিদের এই দীর্ঘ সংঘাতের পেছনের ইতিহাস অনেক পুরোনো।

শত বছরের পুরনো ইস্যু

মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের যে এলাকা, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

আরও পড়ুন: শিক্ষকদের ওপর দায় না চাপিয়ে শীর্ষপদে নিয়োগের পদ্ধতি বদলাতে হবে

তখন ফিলিস্তিনে যারা থাকতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেইসঙ্গে কিছু ইহুদি।

কিন্তু, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করল, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্তরাজ্যকে ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তিনে একটি ‘জাতীয় আবাস’ বা বাসস্থান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিল।

ইহুদিরা এই অঞ্চলকে তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি বলে দাবি করে। কিন্তু, আরবরা এই ভূমি তাদের দাবি করে ইহুদিদের জন্য সেখানে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টার বিরোধিতা করে।

১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে তারা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল।

ফিলিস্তিনে ততদিনে ইহুদি আর আরবদের মধ্যে সহিংসতা বাড়া শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। এ ক্ষেত্রে জেরুজালেমকে প্রস্তাব করা হলো আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদী নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নিলেও আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের এই পরিকল্পনা আর কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি।

ইসরায়েল সৃষ্টি ও ‘মহাবিপর্যয়’

ব্রিটিশরা দ্বিরাষ্ট্র প্রস্তাবজনিত সমস্যার কোনো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে। ইহুদি নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।

বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানায়। এবং এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সৈন্যরাও আসে যুদ্ধ করতে।

হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তখন হয় তাদের ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে হয়, নতুবা চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহাবিপর্যয়’ বলে থাকে।

পরের বছর এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন যুদ্ধ শেষ হলো, ততদিনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। আর, জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিসর দখল করেছিল গাজা।

জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়। ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে নগরীর পশ্চিম অংশ, আর জর্ডানের বাহিনী পূর্ব অংশ।

দুপক্ষের মধ্যে যেহেতু কখনোই কোনো শান্তি চুক্তি হয়নি, তাই উভয় পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে পরের দশকগুলোতে এ নিয়ে বহুবার যুদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন: চলতি মাসে খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

১৯৬৭ সালে আরেকটি যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা, এবং মিসরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়।

বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী থাকে গাজা ও পশ্চিম তীরে। প্রতিবেশী জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননেও আছে অনেক ফিলিস্তিনি।

ইসরায়েল এই ফিলিস্তিনি এবং তাদের বংশধরদের কাউকেই আর তাদের বাড়িঘরে ফিরতে দেয়নি। ইসরায়েল বলে থাকে, এদের ফিরতে দিলে সেই চাপ ইসরায়েল নিতে পারবে না। এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

ইসরায়েল এখনও পশ্চিম তীর দখল করে আছে। গাজা থেকে তারা যদিও সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে, জাতিসংঘের দৃষ্টিতে এটি এখনও ইসরায়েলের দখলে থাকা একটি এলাকা।

ইসরায়েল এখন পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা দাবি করে পূর্ব জেরুজালেম তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী। পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ।

আরও পড়ুন: কুবির নির্মাণাধীন প্রধান ফটকের রড চুরি

পঞ্চাশ বছর ধরে ইসরায়েল এসব দখল করা জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদি এখন এসব এলাকায় থাকে।

ফিলিস্তিনিরা বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরায়েল তা মনে করে না।

এখনকার পরিস্থিতি কী?

ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের মধ্যে কিছুদিন পরপরই উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। পূর্ব জেরুজালেম, গাজা ও পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকে, তাদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের উত্তেজনা প্রায়ই চরমে উঠে।

গাজা শাসন করে কট্টরপন্থি ফিলিস্তিনি দল হামাস। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বহুবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল ও মিসর, যাতে হামাসের কাছে কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে।

গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছে, ইসরায়েলের নানা পদক্ষেপ এবং কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা নিদারুণ দুর্দশার মধ্যে আছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল দাবি করে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়।

চলতি বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি পবিত্র রমজানের শুরু থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তখন প্রায় প্রতি রাতেই ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।

পূর্ব জেরুজালেম থেকে কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি ফিলিস্তিনিদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

মূল সমস্যাগুলো কী?

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিরা বেশ কয়েকটি ইস্যুতে একমত হতে পারছে না। এর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ব্যাপারে কী হবে; পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো থাকবে, না কি সরিয়ে নেওয়া হবে; জেরুজালেম নগরী কি উভয়ের মধ্যে ভাগাভাগি হবে? আর, সবচেয়ে জটিল ইস্যু হচ্ছে—ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন।

পঁচিশ বছর ধরেই এসব ইস্যুতে শান্তি আলোচনা চলছে থেমে থেমে। কিন্তু সংঘাতের কোনো সমাধান এখনও মেলেনি।

তাহলে ভবিষ্যৎ কী?

এক কথায় বলতে গেলে, খুব সহসা এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান মিলবে না।

সংকট সমাধানের সর্ব-সাম্প্রতিক উদ্যোগটি নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই উদ্যোগকে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু, ফিলিস্তিনিরা এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছিল একতরফা একটি উদ্যোগ বলে। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত আর এগোয়নি।

ভবিষ্যতের যেকোনো শান্তি চুক্তির জন্য দুপক্ষকে জটিল সব সমস্যার সমাধানে একমত হতে হবে। সেটি যতদিন না হচ্ছে, দুপক্ষের এই সংঘাত চলতেই থাকবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা