শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিশু-কিশোরদের করোনা ঝুঁকি কমার দাবিটি সঠিক নয়

শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী   © ফাইল ফটো

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিশু-কিশোরদের করোনা ঝুঁকি কমবে এমন দাবি সংবলিত একটি ফেসবুক পোস্ট সম্প্রতি ভাইরাল হয়। তাতে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের বরাত দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং শিশুকিশোরদের করোনাঝুঁকিসহ করোনা শুধুমাত্র বাতাসে ছড়ায় এমন আরও কয়েকটি দাবির কথা বলা হয়। মূলত ল্যানসেটে এমন কোনো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিতই হয়নি বরং করোনা বাতাসে ছড়াতে পারে, এ সংক্রান্ত একটি মন্তব্যমূলক প্রতিবেদন ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় গত ১৫ এপ্রিল। তাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ছয় বিজ্ঞানী দশটি পয়েন্টের মাধ্যমে তাদের কিছু অভিমত তুলে ধরেছেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে ল্যানসেটের কথিত গবেষণা প্রবন্ধের বরাতে বলা হয়েছে, ‘ঘর থেকে স্কুল, কলেজ অনেক অনেক নিরাপদ প্রমাণ করা হয়েছে। ল্যানসেট তাই সারা বিশ্বে বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, চীন এসব ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অবিলম্বে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভ্যাকসিন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে বলা হয়েছে। এতে শিক্ষার উন্নতির সাথে শিশু কিশোরদের কোভিড হবার সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে।’ ল্যানসেটের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদনে এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ভাইরাল হওয়া ল্যানসেটের প্রতিবেদন দাবি করা পোস্টে বলা হয়েছে, ‘কোভিড রোগ কোনমতেই হাঁচি, কাশি, কফ, থুতু দিয়ে ছড়ায় না। এটি পোশাক, জুতো, আসবাবপত্র, ধাতু, চামড়া এসব দিয়ে ছড়ায় না। রোগীর ব্যবহার করা কোনো জিনিস এর স্পর্শে এই রোগ ছড়ায় না। এমনকি যানবাহন এর হাতল, সিঁড়ি এসবের মাধ্যমে ছড়ায় না।’ আসলে ল্যানসেটের মন্তব্যমূলক প্রতিবেদনটিতে এমন কিছু বলা নেই।

ল্যানসেট প্রতিবেদনের বরাতে আরও বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসের জীবাণু ছড়ায় রোগীর কথা, নিঃশ্বাস বায়ু, হাসি, চিৎকার এমনকি গান থেকেও।’ ল্যানসেটের মূল মন্তব্যমূলক প্রতিবেদনটিতে এমন কথাও উল্লেখ করা হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টে ল্যানসেটের বরাতে সবচেয়ে মারাত্মক যে দাবি করা হয় তা হলো- ‘ঘরের বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে রোগ হবার সম্ভাবনা বহু গুণ বেশী এবং সে রোগ ভয়াবহ হবার সম্ভাবনাও ঘরেই অনেক বেশি। বারবার হাত ধুয়ে, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, বাইরে থেকে ফিরেই জামাকাপড় স্যানিটাইজ করলে কোনো লাভ নেই। এটি এখন প্রমাণিত যে যারা বাইরে ঘুরেছেন তাঁদের চেয়ে যারা ঘরে বদ্ধ থেকেছেন, তাঁদের রোগ হয়েছে বহুগুণ বেশী, এমনকি ভেন্টিলেটর এর প্রয়োজন বা মৃত্যুও হয়েছে তাঁদের অনেকগুণ বেশি। বলা হয়েছে ঘরের থেকে রাস্তা, বড় বাগান, জঙ্গল, নদী এসব এলাকা বহুগুণ ভালো। এমনকি ঘরের থেকে শপিং মলও ভালো বলা হয়েছে, কারণ সেখানে জায়গা অনেক বেশি, তাই বাতাসে জীবাণুর ঘনত্ব কম।’

উপরোক্ত প্রসঙ্গে ল্যানসেটের মূল প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘আক্রান্তদের ৩৩ থেকে ৫৯ শতাংশ উপসর্গহীন, যেটি বায়ুবাহিত হয়ে সংক্রমণের ভিত্তিকে জোরালো করছে। বাইরের তুলনায় আবদ্ধ স্থানে সংক্রমণের হার বেশি।’

ল্যানসেটের মন্তব্য প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ছয় বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা করা দশটি পয়েন্ট হলো :

১. সুপার-স্প্রেডার (অতিমাত্রায় সংক্রমণ) ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে মানুষের আচরণ, কোন পরিসরে ঘটেছে, ঘরের ভেন্টিলেশন বা বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ইত্যাদি খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট যে, শ্বাস-প্রশ্বাসে নির্গত জলকণা বা ড্রপলেটসের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানো প্রায় অসম্ভব।

২. পাশাপাশি কক্ষে থাকা ব্যক্তি, আক্রান্তের মুখোমুখি না হয়ে বা সংস্পর্শে না এসেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা রয়েছে।

৩. আক্রান্তদের ৩৩ থেকে ৫৯ শতাংশ উপসর্গহীন, যেটি বায়ুবাহিত হয়ে সংক্রমণের ভিত্তিকে আরও জোরালো করছে।

৪. বাইরের তুলনায় আবদ্ধ স্থানে সংক্রমণের হার বেশি।

৫. হাসপাতাল কর্মীরা সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না এসেও বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী বা পিপিই পরেও আক্রান্ত হচ্ছেন।

৬. কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তির ঘরের বাতাসে ভাইরাস মিলেছে।

৭. কোভিড হাসপাতালের এয়ার ফিল্টারে ভাইরাস পাওয়া গেছে।

৮. খাঁচাবন্দি প্রাণীরা এয়ার ডাক্ট থেকে সংক্রমিত হয়েছে।

৯. কোনো গবেষণায় এ পর্যন্ত ভাইরাসটি বায়ুবাহিত না হওয়ার পক্ষে প্রমাণ নেই।

১০. ড্রপলেটস বা জলকণার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর তেমন বিশেষ কোনো প্রমাণ নেই।


সর্বশেষ সংবাদ