করোনার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে বিপদে যেসব দেশ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © সংগৃহীত

করোনা মহামারির কারণে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে এ অবস্থায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বন্ধ রয়েছে শিক্ষা-কার্যক্রম। তবে করোনার প্রকোপ আপতত কিছুটা কমায় কয়েকটি দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর করোনা সংক্রমণের হার আবারো বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশেও করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। এমতাবস্থায় সরকার আগামী ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। করোনা আক্রান্তের হার আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা কমের দিকে এলেও এখনও কেউ ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মত দিয়েছেন দেশী ও বিদেশী বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ শিক্ষার ক্ষতির কথা চিন্তা করে হুট করেই শিক্ষাঙ্গন খুলেছে তাদের প্রত্যেককেই আবার তা বন্ধ করতে হচ্ছে আক্রান্ত নতুন করে বেড়ে যাওয়ার কারণে। পৃথিবীর সবচেয়ে কম জনবহুল ও উন্নত দেশও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পরিস্থিতি এখনও সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সতর্ক হতে হবে বাংলাদেশকেও। কারণ এখানে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত প্রতিটি দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

তারার আরও বলছেন, এখানে শিক্ষাঙ্গন খুলে কোটি কোটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের ঝুঁকিমুক্ত রাখা একেবারেই অসম্ভব। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা করোনায় শিক্ষার ক্ষতির কথা বললেও একই সঙ্গে অধিকাংশই বলছেন, এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গবেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো জনবহুল কোন দেশেই বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা উচিত নয়। গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা এটাই প্রমাণ করে যে ‘সংক্রমণ হার ঝুঁকিমুক্ত না হলে কোন দেশের জন্যই শিক্ষাঙ্গন চালু করা ঝুঁকিমুক্ত নয়।

খোলার পর বিশ্ব পরিস্থিতি:

সারাবিশ্বে করোনা মোকাবেলায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে সারাবিশ্বে পরিচিত ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কেরালা। সেই কেরালাও আক্রান্ত কমছে এ চিন্তা থেকে শিক্ষাঙ্গন খুলে নতুন করে বিপদে পড়েছে। কেরালায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেই শিক্ষার্থীদের নেয়া শুরু হয়েছিল ক্লাসে। কেবল দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়াদের ক্লাস খোলা হয়েছিল। তারপরও রাজ্যের মালাপ্পুরাম জেলায় পাশাপাশি দুটি স্কুলের দশম শ্রেণীর ১৮৯ জন শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়।

একই সঙ্গে স্কুলে ৭০ জন শিক্ষক ও কর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। মারানচেরিতে একটি সরকারী স্কুলের ১৫০ শিক্ষার্থী ও ৩৪ জন শিক্ষক এবং পুন্নানি এলাকার ভ্যান্নেরি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৯ শিক্ষার্থী এবং ৩৬ শিক্ষক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ ঘটনায় স্কুল দুটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

স্কুল খোলার পর নতুন করে করোনার ছোবলে পড়েছে মহারাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরাও। খোলার পর রাজ্যের এক স্কুল হোস্টেলের ২২৯ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে ওই হোস্টেলের চার শিক্ষকও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মহারাষ্ট্রের ওয়াসিম জেলার দেগাঁওয়ের একটি আদিবাসীদের জন্য নির্মিত ভাবনা স্কুলে এ ঘটনা ঘটেছে।

স্বাস্থ্য বিধি মেনে কিছুদিন আগে কেবল নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাস শুরু করেছিল অন্ধ্রপ্রদেশ। তবে স্কুল খুলেই মহাবিপদে পড়ে প্রদেশটি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ক্লাসে আসছে না। তাতেই ৫৭৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৮২২ জন শিক্ষক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে গিয়ে সর্বশেষ ধাক্কা খেয়েছে ব্রিটেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাজ্য সরকার নিজ দেশের পরীক্ষা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

করোনার মধ্যেই প্রথমে গত বছর জুলাইয়ে কিছু স্কুল খুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই স্কুল খোলার অনুমতি দিয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। তবে প্রথম দু-সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বিতর্কে পড়ে তখনকার ট্রাম্প প্রশাসন। এক পর্যায়ে ওইসব স্কুল আবার বন্ধ করতে হয়।

করোনা না সামলেই গেল বছরের শেষের দিকে স্কুল খুলেছিল জিম্বাবুইয়ে। তবে খোলার পরই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এক শ’ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। পরে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ইতালি স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দীর্ঘ ছয় মাস বন্ধ রেখে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছিল। পরবর্তীতে সরকারী হিসেবেই দেখা যায়, স্কুল খোলার আগে ও পরে মিলিয়ে অন্তত ১৩ হাজার স্কুল শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

ফ্রান্সে স্কুল খোলার পরই ৭০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়। ফ্রান্সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে। দীর্ঘ বন্ধের পর আবার যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছু কিছু খোলা হয় তখনই বাঁধে বিপত্তি। ফ্রান্সে একদিকে কঠোর স্বাস্থ্য বিধি অন্যদিকে একেকটি শ্রেণীতে হাতেগোনা শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা হলেও আক্রান্ত হওয়া বন্ধ থাকেনি।

দীর্ঘ বন্ধের পর গেল বছরের শেষ দিকে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার স্কুল খোলার পরপরই রাজধানী ভিয়েনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় চার শত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তার করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। স্পেনেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে স্কুল খোলার এক সপ্তাহের মাথায়ই অর্ধ শতাধিক স্কুলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের গবেষকরা বলছেন, সংক্রমণ হার বেশি থাকা অবস্থায় কোন দেশের জন্যই শিক্ষাঙ্গন চালু করা ঝুঁকিমুক্ত নয়। মহামারী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার পর যখন নতুন সংক্রমণ হার স্থিরভাবে পড়তির দিকে অবস্থান করবে, কেবলমাত্র তখনই বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

ঠিক এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো জনবহুল শিক্ষাঙ্গনের দেশেই বা কি করণীয়? করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি সঠিক পথেই আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন জরিপ ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পথেই আছে সরকারের পদক্ষেপ।

বিভিন্ন জরিপেও দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা এখনও শিক্ষাঙ্গন খোলাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেই মনে করছেন। শিক্ষায় ক্ষতি হচ্ছে বলে স্বীকার করলেও এখনও শিক্ষাঙ্গন খুললে কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বলছেন, খোলার পূর্বে আমাদের সবার একবার আমাদের দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া উচিত। কারণ আমাদের দেশে কেবল পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত যাতায়াত করে যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। প্রতিষ্ঠান খুললেও এর সঙ্গে যাতায়াত করতে হয় আরও প্রায় সমানসংখ্যক অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট মানুষকে। যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জনসংখ্যার থেকেও বেশি।

খোলার পূর্বে আমাদের সবার দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক ও শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ একমরামুল কবির।

তিনি জানান, আমাদের ক্লাস রুমগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত সকল দেশের তুলনায়ই কয়েকগুণ বেশি। এক প্রকার গাদাগাদি করে বসে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করেন। এক একটি বেঞ্চে তিন, চার বা পাঁচজন করে বসতে হয়। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে এক একটি শিক্ষাঙ্গন। লাখ লাখ শিক্ষার্থী অভিভাবক যাতায়াত করেন। এমন অবস্থার মধ্যে আসলে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয় না। তাই সরকার ভেবে চিন্তেই কাজ করছে। অন্যথায় হুট করে কিছু করতে গেছে মহা সঙ্কটে পড়তে হবে বলেও জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল খোলার দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের কারণে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে শিক্ষার্থী এবং দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য। খোলা হলে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয় তাদের পরিবারও করোনার ঝুঁকিতে থাকবেন কারণ তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করলে তারাও ঝুঁকিতে পড়বেন।


সর্বশেষ সংবাদ