করোনা মহামারি যেভাবে আমাদের ‘স্বপ্ন’ বদলে দিচ্ছে

  © বিবিসি

করোনাভাইরাস মহামারি হিসাবে দেখা দেয়া এবং বিশ্বজুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর গবেষকরা মানুষের স্বপ্নের তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ফিলিপিন্স থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা অনেকেই অস্বাভাবিক গভীর আর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন।

লকডাউনে থাকার দুই সপ্তাহ পর থেকে ফিলিপিন্সের ১৯ বছর বয়সী একজন বাসিন্দা অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ‘আমি দেখলাম, মধ্যরাতে আমাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং একজন চিকিৎসক আমার হাতে অপারেশন করছেন,’ বলছেন, এলিসা অ্যাঞ্জেলিস।

‘কয়েক মুহূর্ত পরে আমার মনে হতে লাগলো, আমার শুধু যেন একটি হাত আছে। এমনকি আমি দেখতে পেলাম, ডাক্তার আশেপাশে হাটাহাটি করছেন এবং আমার বিচ্ছিন্ন হাত নিয়ে খেলা করছেন। আমার মনে হচ্ছিল, আমার যেন সব শেষ হয়ে গেছে।’

পরের কয়েকদিন তিনি আরও কিছু হারানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ‘হয়তো আমার টাকা হারিয়ে গেছে অথবা আমার ল্যাপটপ হারিয়ে গেছে।’ এরকম স্বপ্ন দেখা মানুষ এলিসা একাই নন। করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বই রাতারাতি বদলে গেছে, তেমনিভাবে বদলে গেছে মানুষের স্বপ্নও।

অনেক মানুষ জানিয়েছেন, ভাইরাসের বিস্তার আর লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে তারা এখন অনেক বেশি গভীর আর বিচিত্র ধরণের স্বপ্ন দেখছেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডেইরড্রে ব্যারেট গত মার্চ মাস থেকে মানুষের স্বপ্নের তথ্য জোগাড় করতে শুরু করেছেন, এই মহামারির কারণে তা কতটা বদলেছে।

‘যেকোনো বড় ধরণের চাপ তৈরি হলেই মানুষের অদ্ভুত, উদ্বেগের স্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়-আমার জরিপেও সেটাই ব্যাপকভাবে বেরিয়ে এসেছে,’ তিনি বলছেন। অনেকে জানিয়েছেন, তাদের স্বপ্ন অনেক সময় করোনাভাইরাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।

যেমন একজন বলেছেন, কন্টাজিয়ন সিনেমা দেখার পর তিনি স্বপ্নে দেখতে পান যে, তার কোভিড-১৯ হয়েছে। ‘আমি যেন শারীরিকভাবে সেই কষ্ট টের পাচ্ছিলাম, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, আমার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি মারাই যাচ্ছি। এরপর আমাকে কোন একটা ওষুধ দেয়া হলো আমি যেন অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলাম।’

এর আগে বেশ কয়েকটি বড় উত্তেজনাকর ঘটনার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন ডেইরড্রে। যেমন আমেরিকার নাইন ইলেভেন, ইরাকের দখলের পর কুয়েতি নাগরিকদের ওপর প্রভাব এবং নাৎসি ক্যাম্পে বন্দী হওয়া ব্রিটিশ সৈনিকদের মানসিক অবস্থা। এক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যুদ্ধের সময়ে অনেক খণ্ড খণ্ড অদ্ভুত চিত্র মানুষের স্বপ্নের ভেতর আসে। তবে বর্তমান মহামারির চিত্র আলাদা।

এটা একটা অদৃশ্য শত্রু এবং সেটি মানুষের মনোজগতে নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে, তিনি বলছেন। ‘আমরা এমন অনেককে পেয়েছি যারা পোকার মধ্যে সাতার কাটা, সুনামি, হ্যারিকেন, টর্নেডো, ভূমিকম্পের মতো স্বপ্ন দেখেছেন।’ ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ার কাউন্টির ২৪ বছরের চার্লি মাকড়শা নিয়ে ভীতিকর সব স্বপ্ন দেখেছেন।

‘একটি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি, বিশাল একটা মাকড়শা নীচ থেকে গুড়ি মেরে আমার বিছানায় উঠে আসছে। সেটার আকৃতি একটা বিড়ালের মতো। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলাম।’ এই স্বপ্ন বিভিন্ন সময়ে দেখেছেন চার্লি।

যদিও মাকড়শার আকৃতি একেক সময় একেক রকম হয়েছে, কিন্তু তিনি স্বপ্নগুলো সবসময়েই দেখেছেন নিজের ঘরে। ‘এটা আমার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, বিশেষ করে আমার নিজের বিছানা। ফলে এটা আরও বেশি বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল।’

ডেয়ারড্রে মনে করেন, নিজ বাড়িতে থাকার সময় অনেক মানুষ এসব স্বপ্ন দেখার কারণে তারা আরও ভালোভাবে নানা খুঁটিনাটি মনে করতে পারেন। এর একটি কারণ হতে পারে, মানুষ এখন বেশি সময় ধরে ঘুমাচ্ছে, অনেক সময় কোন অ্যালার্ম ঘড়ির ওঠার তাড়া ছাড়াই।

‘যাদের অনেকেই লম্বা সময় ধরে কাজ করার কারণে বা সামাজিক ব্যস্ততার কারণে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারতেন না, তারা এই সময়ে ঘুমের অভাব পুষিয়ে নিতে পারছেন।’ তার গবেষণার আরেকজন ব্যক্তি স্বপ্ন দেখেছেন যে, তিনি একটি পার্কে বসেছিলেন, সেই সময় কিছু খারাপ ঘটনা ঘটতে শুরু করে।

‘আমি পার্কের একটি বেঞ্চে বলে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে আমরা কিছু শব্দ শুনতে পাই এবং দেখতে পাই, বিশাল একটি রিভলভার আকাশ থেকে আমাদের তাক করে নেমে আসছে।’ সেটা দ্রুত নেমে এসে মানুষজনকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরে করে। ‘এটা আমার দিকে তাক করে এবং আমি ভয়ে দৌড়িয়ে লুকানোর চেষ্টা করি।’

মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয়গুলোর একটি স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটি, যা সবচেয়ে অদ্ভুত এবং সবচেয়ে কম ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।

লুইগি ডে জেনারো, যিনি মহামারি শুরু হওয়ার পর আটকে থাকা ইটালিয়ানদের দুঃস্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন, নিজেদের দেখা স্বপ্ন ঠিকঠাকভাবে মনে করতে পারার সক্ষমতা মানুষের রাতারাতি বেড়ে গেছে। উদ্বেগের কারণে ভালো ঘুম না হলে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখার প্রবণতা বাড়ে।অনেক সময় রাতে মানুষের বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাবার ফলে এ ঘটনা ঘটে।

আবার অনেক সময় তারা এমন একটি অবস্থায় থাকেন যাকে বলা হয় র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম। আরইএম ঘুমে চোখ নড়তে থাকে, শ্বাস এবং রক্তপ্রবাহ দ্রুত হয়ে যায় এবং শরীর একটি অবশ অবস্থায় চলে যায়, যাকে বলা হয় অ্যাটোনিয়া। ঘুমের মধ্যে ৯০ মিনিট পরপর এরকম ঘটতে পারে এবং সেরকম সময়ে আমাদের মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

সুতরাং কেউ যদি আরইএম পর্যায়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, তারা তাদের স্বপ্নগুলো বেশি ভালোভাবে মনে রাখতে পারেন। ‘এই মহামারির ক্ষেত্রে স্বপ্ন একটি আবেগি প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে,’ তিনি বলছেন। ‘আমাদের হিসাবে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন, এরকম তথ্য দেয়া মানুষের সংখ্যা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে।’

ডাবলিনের নিয়াম ডেভেরেক্স দেখতে পেয়েছেন, তিনি যখন বাসার একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন,তখন বাগানে একটি নগ্ন ভুত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২৮ বছর বয়সী এই নারী বলছেন, ‘ভীতিকর নগ্ন এক ভুত আমাদের চারপাশে ঘুরছে, সেই সঙ্গে চারদিকে অনেক ভেড়াও ঘুরছে। আমি ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম।’

বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন যে, আমাদের প্রত্যাহিক কাজের ধরণ স্বপ্নের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। মানসিকভাবে সেসব কাজের সঙ্গে যতটা সম্পৃক্ত থাকা হয়, স্বপ্নের ওপরও সেটাই ততো বেশি প্রভাব ফেলে। এটি মানুষকে দুঃস্বপ্নের প্রতি আরও বেশি নাজুক করে তোলে।

সম্প্রতি ইতালি একটি ‘ইম্যুনি’ নামের একটি কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং অ্যাপের অনুমোদন দিয়েছে, যা করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সহায়তা করতে বলে আশা করা হচ্ছে। এই খবরটি টেলিভিশনে দেখার পর ইতালির বাসিন্দা কার্লোত্তার স্বপ্নেও চলে আসে।

‘আমি স্বপ্নে দেখছিলাম, যে ঘুম থেকে জেগে উঠেছি আর কিছু একটা যেন আমার মাথা জুড়ে রয়েছে। আমি টয়লেটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। কপাল থেকে যখন আমি চুল সরালাম, দেখতে পেলাম সেখানে তিনটা বাটন রয়েছে।’

তিনি তার এই স্বপ্নটি ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট আইড্রিমঅফকোভিড নামের একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ইরিন গ্রাভলি এই ওয়েবসাইটটি চালু করেছেন। তিনি কোন বিজ্ঞানী বা গবেষক নন। তবে মানুষের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা দেখে তার মাথায় এই ওয়েবসাইটের আইডিয়া আসে।

‘মানুষ একজনের কাছ থেকে আরেকজন ছয় ফিট দূরত্বে দাঁড়াচ্ছে, হাত মেলাচ্ছে না। আমি ভাবলাম, এই সংকট মানুষের স্বপ্নের ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে?’ একটি ইমেইল সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন। এই ওয়েবসাইটে প্রতিটা স্বপ্ন পোস্ট করার আগে একটি চিত্র একে দেন তার বোন।

এরিন আশা করছেন, তার এই প্রকল্পের মাধ্যমে মহামারির সময় মানুষের দেখা স্বপ্নের ধরণ চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। তিনি বলছেন, ‘এর ফলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে যে, এই সময়ে মানুষের স্বপ্ন কেমন ছিল।’

মনে হতে পারে যেন এই মহামারির সময়ে সবাই শুধুমাত্র নেতিবাচক স্বপ্নই দেখছেন। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ‘শুনতে অবাক শোনাতে পারে, কিন্তু অনেক মানুষ এই সময়ে বেশ ইতিবাচক স্বপ্নও দেখছেন,’ বলছেন ডেইরড্রে ব্যারেট। ‘অনেক মানুষ স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছেন, যেখানে বর্তমান দূষণ নেই অথবা কেউ কেউ স্বপ্নে করোনাভাইরাসের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন।’

এই ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাদের একজন ভারতের নিউ দিল্লির নেরু মালহোত্রা। ‘লকডাউন শুরু হওয়ার পর, আমি চমৎকার সব হোটেল রুম স্বপ্নে দেখতে শুরু করলাম। এগুলো এর আগে আমি শুধু টেলিভিশন পর্দাতেই দেখেছি।’

‘বিশাল বিশাল জানালার এই রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায়, মাঝে মাঝে বিস্তৃত সবুজ দেখা যায়। আমার খুব ভালো লাগে। আশেপাশে খুব বেশি মানুষ থাকে না। পুরো দৃশ্য মোহিত করে তোলে।’

তবে আপনি যদি চিন্তা করে থাকেন যে, কীভাবে স্বপ্নকে আরও বেশি শান্তিপূর্ণ করে তোলা যায়, সে বিষয়ে ঘুম বিশেষজ্ঞদের কিছু উত্তর রয়েছে। ‘যাকে আমরা ঘুমের চাষাবাদ বলে থাকি, আপনি যখন ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করবেন, তখন আপনি নিজেকে নিজে পরামর্শ দিতে পারেন যে, কী ধরণের স্বপ্ন আপনি দেখতে চান,’ বলছেন ডেইরড্রে ব্যারেট।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘আপনার প্রিয় কোন মানুষকে নিয়ে ভাবুন, কোন প্রিয় স্থান অথবা কোন পুরনো ভালো স্বপ্নের কথা ভাবুন। যখন আপনি ঘুমিয়ে পড়তে থাকবেন, তখন বারবার মনে করুন যে, আপনি কি স্বপ্ন দেখতে চান। আপনি যখন ঘুমিয়ে পড়তে থাকবেন,তখন এই কৌশল এক আরামদায়ক অনুভূতি তৈরি করবে এবং আপনার ঘুমন্ত মন আপনার সেই অনুরোধ রাখার চেষ্টা করবে।’


সর্বশেষ সংবাদ