এরশাদের পতন: নেপথ্যে যা ছিল
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৫ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫০ PM
তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই দিনকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। তবে দেশটির বৃহৎ দুটি দল বিএনপি দিনটিকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ ও আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করলেও এরশাদের তৈরি দল জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।
প্রায় তিনদশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা হুসেই মোহাম্মদ এরশাদ কীভাবে রাজনীতিতে টিকে রয়েছেন এবং এরশাদের পতনে পর্দার আড়ালে কি ঘটেছিলো? তা নিয়ে জানার আগ্রহের শেষ নেই।
১৯৯০ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চিকিৎসক নেতা ডা: শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যার পর এরশাদ পতনের আন্দোলন তখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের দেশ পরিচালনার ভূমিকা ও এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অবস্থান কেমন হওয়া উচিত তারই আলোচনা করতে ওই বছরের ডিসেম্বরের ১ তারিখে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় এটি রাজনৈতিক ব্যাপার এখানে সেনাবাহিনীর কিছু করার নেই। এজন্য রাষ্ট্রপতিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। তবে এরশাদ প্রস্তাব দিয়েছিলেন সামরিক শাসন জারির।
এর কয়েকদিন পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করতে যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন। সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিনকে সেনা সদস্যরা প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগের জন্য সরাসরি বলতে বলেন। জেনারেল নূর উদ্দিন এরশাদকে জানান, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা কোন দায়িত্ব নিতে রাজী হচ্ছে না। পরে জানা যায়, জেনারেল নূর উদ্দিন এরশাদকে সেদিন পদত্যাগের কথা বলেন নি।
২০১০ সালে গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার দেন জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী। সে সময় তিনি ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে পরলোকগমন করেন আমিন আহমেদ। মৃত্যুর আগে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন সেদিন সেনাপ্রধান এরশাদকে কি বলেছিলেন। তিনি জানান, ‘উনি (জেনারেল নূর উদ্দিন) প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, আপনার উচিত হবে বিষয়টির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করা। অথবা বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেয়া। সামরিক শাসন জারীর বিষয়ে সেনাবাহিনী একমত নয় বলে প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন সেনাপ্রধান আমিন।’
তিনি বলেন, ‘এরপর ডিসেম্বরের ৪ তারিখে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি পদত্যাগ করার কথা বলেন। অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। আর্মি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে।’ আর এই বৈঠক নিয়ে সে সময় দেশজুড়ে নান গুঞ্জন তৈরি হয়। দেশটির জনগণ বিভিন্ন অনুমান করতে থাকেন। রাস্তায় এরশাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরো জোরালো হতে থাকে। অন্যদিকে সেনা নিবাসের তৎপরতা, তখন সব মিলিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
গণআন্দোলন দমাতে জরুরি অবস্থা এবং কারফিউর মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। তারপরেও আন্দোলন থামানো যাচ্ছিল না। অপরদিকে সেনাবাহিনীর এমন নেতিবাচক মনোভাব সবমিলিয়ে সেদিন রাতেই (৪ ডিসেম্বর) পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ। সেনাবাহিনীর মনোভাব বোঝার পরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি এরশাদ বলে জানান সে সময়ের এরশাদ সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমেদ।
ছন্দপতনের মধ্য দিয়েও এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। কিন্তু ১৯৮৭ সালে একটি মিছিলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হওয়ার পর আন্দোলন বেগবান হয়। আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি'র নেতৃত্বে রাজনৈতিক জোট। মাঠে ছিল জামায়াতে ইসলামীও। ১৯৯০ সালে ছাত্র সংগঠনগুলো 'সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের' ব্যানারে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন মোকাবেলার এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন এরশাদ। এজন্য সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলো এরশাদের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রেসিডেন্টের পরিকল্পিত নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরতে ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে তখনকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার জন্য বাংলাদেশে টেলিভিশনে পাঠিয়েছিলেন।
এরশাদ চেয়েছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করা। যদিও আগেই বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনের প্রস্তাব আগেই বর্জন করেছিলেন। মওদুদ আহমদ সন্ধ্যার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়ে ভাষণ রেকর্ডও করেছিলেন। কিন্তু মওদুদ আহমদ যখন বাসায় ফিরে জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে মধ্যরাতে মওদুদ আহমেদকে আবারো বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা দেবার জন্য। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]