বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একই সূত্রে গাঁথা
- ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
- প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২২, ১০:১১ PM , আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২২, ১০:১১ PM
আজ ১৬ জুলাই। ২০০৭ সালের এই দিনে গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের শাসনকে দীর্ঘ মেয়াদী করা এবং দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘মাইনাস ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের অপচেষ্টায় মূলত কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে। নিত্যদিনকার অভ্যাস অনুযায়ী সেদিনও শেখ হাসিনা ফজরের নামাজ শেষ করলেন। তার আগে থেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য সুধা সদন ঘিরে রাখে; যেন এক রণ-প্রস্তুতি। সাদা ওড়নায় মাথা আর শরীরাবৃৃত শেখ হাসিনার হাতে তখনো মেরুন রঙের তসবিহ মোড়ানো। প্রভাত সমীরণকে বিষাক্ত করে দিয়ে সেই অবস্থায়ই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে, সমগ্র বিশ্বের মানুষ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছিল সেই গ্রেফতারের নির্মম, অমানবিক দৃশ্য, অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাঁকে নাজেহাল করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম কোর্টে, প্রেরণের আদেশ হয় কারাগারে; মহান জাতীয় সংসদকেই কারাগারে পরিণত করা হয়, রাখা হয় তাঁকে সংসদ চত্বরে স্থাপিত সাব-জেলে।
সেখানে আয়েশি জীবন নয়, বরং দুঃসহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে, অবর্ণনীয় দুঃখ-যাতনা সইতে হয়েছে সাব-জেলে; শেখ হাসিনা রচিত ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে রয়েছে সেই দুঃখ-গাঁথার নির্মম উপাখ্যান। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দৃঢ়চেতা মনোবল আর অকৃত্রিম দেশপ্রেম সেদিন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গ্রেফতারের পূর্বে দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা তেজোদীপ্ত চিঠি আর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তাঁর ৩৬ মিনিটের প্রদত্ত ভাষণ আমাদের ভগ্ন-হৃদয়কে আশান্বিত করেছিল, আমরা উজ্জীবিত হয়েছিলাম। মহানগর আওয়ামী লীগের সংগ্রহ করা ২৫ লাখ স্বাক্ষর, দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের প্রতিবাদ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত অজস্র মানুষের অবিরাম প্রয়াস ও প্রার্থনার সাথে যুক্ত হয় বাঙালির জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতিঘর এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গর্জে ওঠা; বিশ্ববিদ্যালয়টি তার অতীত সংগ্রামী ঐতিহ্যের অনুসরণেই সেদিন শেখ হাসিনার গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যায়।
সেদিন ছিল সোমবার। শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদে আমরা কালো ব্যাজ ধারণ করি। কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক লাউঞ্জে আমরা কালো ব্যাজ সরবরাহ করি। অল্প সংখ্যক শিক্ষক সেই কালো ব্যাজ পরিধান করেই আমরা ক্লাসে যাই; আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ঐ অন্যায় ও নির্মম গ্রেফতারের প্রতিবাদ, অন্যদিকে এই প্রতিবাদের লেলিহান শিখা ছাত্র-শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বিক্ষোভ সমাবেশও করি। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে অবস্থান নেয় নানান বাহিনীর সদস্যরা, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা নামে-বেনামে আন্দোলনে সম্পৃক্ত ও নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানির অপপ্রয়াস চালায়। তারা তাঁদের কাছে সময় চায়, দেখা করে কথা বলতে চায়, আকার-ইঙ্গিতে হুমকি-ধমকি দেয়, নানান কৌশলে শিক্ষকদের মাঝে ভীতি ও ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। এমতাবস্থায়ও আমাদের কিছু অসম সাহসী শিক্ষক তাঁদের চেম্বারে বা বাসায় সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের সময় দিয়েছেন, কথা বলেছেন এবং দেশের প্রতি দায়বোধ ও অঙ্গীকারের বিষয় তুলে ধরেছেন।
শেখ হাসিনার মুক্তির ব্যাপারে যেন কোনো কর্মসূচি পালন করা না হয় এবং নিজেরা যেন কোনো আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হন এজন্য নেতৃস্থানীয় শিক্ষকদের প্রতি তারা নানান চাপ অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে কিছু আদর্শ-বিচ্যুত শিক্ষককে তারা নানান প্রলোভন দেখান, পদায়ন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন; সেমতে কিছু শিক্ষক নিজেদের বায়োডাটা নিয়ে নানান তদবিরেও ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যদিও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকেরা এসব প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরিকল্পিত উপায়ে নানান কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন, যেন দেশের এই অসহনীয় অবস্থার অবসান ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ফাঁদে পড়ে ক্যাম্পাসে সেনা ছাউনি স্থাপনের অনুমতি দেয়; যা ছিল খুবই অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বস্তুতপক্ষে ঐ সময় যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন ঐ সরকারের আজ্ঞাবহ।
শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের ১ মাস ৫ দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অভূতপূর্ব ঘটনা সংঘটিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে স্থাপিত সেনা ছাউনির জনৈক সেনা-সদস্যের সাথে খেলার মাঠে কিছু শিক্ষার্থীর প্রথমত বাকবিতন্ডা এবং পরবর্তীতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে; যা দ্রুততার সাথে গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্ট-এর ঘটনা পরম্পরায় তৎকালীন স্বৈরাচারী ও উচ্চাভিলাষী সরকারের ভিত কেঁপে উঠেছিল; যার ফলশ্রুতিতে অন্য সব মানবতাবিরোধী স্বৈরাচারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও চড়াও হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। তারা ভেবেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শায়েস্তা ও পদানত করতে পারলে অথবা নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই তাদের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর কোনো চ্যালেঞ্জ থাকবে না। কিন্তু তাদের এ ধারণা যে শুধু ভুল ছিল তাই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাম্পাসে সৃষ্ট সেই আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর মধ্য দিয়ে তাদের চরম অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার অসহায় চিত্রই তখন ফুটে উঠেছিল।
২০ আগস্ট ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় খেলার মাঠের ঘটনার রেশ ধরে পরবর্তী দু’দিন ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের বিক্ষোভ, সেনা ছাউনি প্রত্যাহার দাবি, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি এসবের ক্রমধারায় ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার হন তৎকালীন শিক্ষক সমিতির দুই নেতা, যথাক্রমে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ; আত্মগোপনে থাকা অপর দুই শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন ও অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক পরবর্তীতে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
উপরিউক্ত পরিস্থিতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে তখন নতুন মাত্রা যোগ করে। শেখ হাসিনার মুক্তি দাবির সাথে শিক্ষকদের মুক্তিদানের বিষয়টি যুক্ত হলে এ আন্দোলন আরো তীব্রতর হতে থাকে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তৎকালীন প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক ইউসুফ হায়দার বক্তব্য রাখছিলেন। কলাভবনের সামনে বটতলায় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে আমরা ক’জন সেখানে যাই এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলি, আগে ‘বন্দির মুক্তি’ নিশ্চিত করেন এবং তারপর বুদ্ধির মুক্তি চর্চা করেন; সেমিনার সেখানেই পণ্ড হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আন্দোলনে তখন মোটাদাগে ৩টি বিষয় জোরালোভাবে উঠে আসে। প্রথমত, শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি; দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং তৃতীয়ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। আমাদের আন্দোলনের ধাপসমূহের মধ্যে ৩টি ছিলো অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, উপরিউক্ত ৩ দাবিতে গণমাধ্যমে ১৬৭জন শিক্ষকের স্বাক্ষর সম্বলিত বিবৃতি প্রদান; দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সমিতির তলবি সভা আহবান এবং তৃতীয়ত, নিপীড়ক সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ঘৃণা প্রকাশ আর ধিক্কারের প্রতীক হিসেবে কলাভবনের শীর্ষ চূড়ায় কালো পতাকা উত্তোলন।
এই ৩টি ধাপ বাস্তবায়নের পেছনে রয়েছে ক’জন প্রতিশ্রুতিশীল আদর্শ শিক্ষকের জীবন বাজি রাখা আর অবিশ্বাস্য সাহসিকতা ও বীরত্ব-গাঁথার ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্ট সেই আন্দোলন পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের সকল রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, সর্বত্রই প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের ঝড় ওঠতে থাকে এবং আন্দোলন ক্রমশ গণবিষ্ফোরণের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে; ফলে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যায় ‘তিন উদ্দিন’-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি মুক্তি দেয় কারাবন্দি শিক্ষকদের এবং ১১ জুন শেখ হাসিনাকে কান ও চোখের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে শেখ হাসিনা সুধা সদনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিছু মানুষকে তাঁর সাক্ষাৎ দেন; সেই সুবাদে আমরা ১০/১২ জন শিক্ষকের একটি প্রতিনিধি দল সবশেষে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করি। তিনি আমাদের অসম সাহসী ভূমিকার উচ্চসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন, ‘আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বিদেশ যাওয়ার আগে সবার শেষে আপনাদের সাথে দেখা করলাম, দোয়া করবেন, বিদেশ থেকে ফেরত এসে সবার আগে আপনাদের সাথেই দেখা করবো।’ তাঁর এই প্রত্যয়ী ও প্রশংসা-সূচক বক্তব্যে আমরা অভিভূত হলাম এবং কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে শুভকামনা জানালাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দল। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-শক্তির শিক্ষকদের এক আদর্শিক ও সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম। এ দলের নেতৃস্থানীয় শিক্ষকেরা দেশ ও জাতির নানা ক্রান্তিকালে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। সে সময় এ দলের কনভেনর ছিলেন অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর; ওয়ান ইলেভেন-এর পর কঠিন সময়টাতে তিনি ব্যক্তিগত কারণে দলের আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে পারেননি। তখন নীল দলের যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ (বর্তমানে প্রো-উপাচার্য, প্রশাসন) এবং অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান (বর্তমানে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট); আহবায়কের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে সামাদ স্যার তখন আহবায়কের দলীয় সকল দায়িত্ব পালন করেন এবং যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে সাইফুল স্যার তাঁকে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেন। ওয়ান ইলেভেনের সেই দুঃসময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীল দলের অধিকাংশ কর্মসূচি প্রণীত হতো কলাভবনের তৃতীয় তলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে।
নানান লেখালেখি, লিফলেট, দলীয় সভার দাওয়াতপত্রাদি, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, দলীয় কার্যক্রমের কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ এসব কাজের সিংহভাগই এ বিভাগ থেকে উপরিউক্ত দু’নেতার নির্দেশ মোতাবেক আমার মাধ্যমেই প্রস্তুত ও বিতরণ হতো। নীল দলের তদানিন্তন দায়িত্বশীল এই দুই শিক্ষকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কী করা যায়, কীভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষকদের মুক্তি নিশ্চিত করা যায় আর কীভাবেই বা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। এসব বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে তাঁরা ছিলেন সদা কর্মতৎপর। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে সামাদ স্যার ও সাইফুল স্যারের কেউই তখন নিজ বাসায় অবস্থান করতে পারেননি; তাঁদের দু’জনকেই সে সময় বেশ ক’দিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। তাঁদের এ আত্মগোপন গ্রেফতারের ভয়ে নয়, বরং গ্রেফতার এড়িয়ে বাইরে থেকে কীভাবে দলীয় কার্যক্রম ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়েই তাঁরা ছিলেন আত্মনিবেদিত। তাই আন্দোলন ও দলীয় কার্যক্রম অব্যাহত পরিচালনার স্বার্থে কৌশলের অংশ হিসেবে সামাদ স্যার লালবাগে কবি আসলাম সানীর বাসায় এবং সাইফুল স্যার প্রথমে রাজধানীর দোলাইপারস্থ আমার বাসায় ও পরবর্তীতে মাওনা চৌরাস্তায় বেশ ক’দিন অবস্থান করেন।
পুরো ক্যাম্পাসে এক ভয় ও আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। নানান বাহিনীর লোকেরা নিয়মিত টহল দিত এবং যাকে-তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহাল করতো। গ্রেফতার ও নির্যাতনের জন্য কোনো কোনো শিক্ষকের বাসভবনে গভীর রাতে যৌথ-বাহিনীর সদস্যরা মহড়া দিতে থাকে। দুদক ও এনবিআর-এর মামলায় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অনেককেই তখন নির্বিচারে গ্রেফতার হতে হয়েছে। এ রকম প্রতিকূল এক পরিবেশে নীল দলের নীতি-নির্ধারক ও নেতৃস্থানীয় শিক্ষক হিসেবে আরেফিন স্যার (সাবেক উপাচার্য), আনোয়ার স্যার (জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য), হারুন স্যার (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য), আখতারুজ্জামান স্যার (বর্তমান উপাচার্য) প্রমুখ তখন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নারী শিক্ষকদের মধ্যে এ আন্দোলনে ড. নাজমা শাহীন, ড. জিনাত হুদা খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং আন্দোলনের নানা পর্যায়ে ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী, ড. এম অহিদুজ্জামান, ড. মো. কামাল উদ্দীন, ড. মেসবাহ কামাল, ড. এম শফিকুজ্জামান, ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন, ড. কাজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী, ড. আবু তোরাব এম এ রহিম ও তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে আমার প্রিয় ভাই ড. রফিকুল ইসলাম, ড. হুমায়ুন কবির, ড. এ এম আমজাদ ও সুরাইয়া আক্তার প্রমুখের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো।
জননেত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে সরকারের শক্ত বাধা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাদেরকে ডাকা হলো। আমরা ১৫/২০ জন শিক্ষক আবারো গেলাম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে। আমরা তাঁর এক আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা মনোবল দেখতে পেলাম; অসম সাহসী ও প্রতিশ্রুতিশীল এক মানসচিত্ত তাঁর মাঝে আমরা আবিষ্কার করলাম। তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে জাতীয় নির্বাচনের কথা বললেন, নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা প্রদানের আহবান জানালেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বহুল প্রত্যাশিত সেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট মহাবিজয় লাভ করলো। কারাবন্দি, নির্যাতিত জননেত্রী হলেন প্রধানমন্ত্রী। আর তখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যকর ও ফলপ্রসু নেতৃত্বেই মূলত শুরু হলো আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা; যা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্যই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
জননেত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি ও দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সেই আন্দোলনের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান; বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ তার এক গর্বিত শিক্ষার্থীর চরম দুর্দিনে তাঁর জন্য সময়োচিত, অনন্য ও মহিমাময় ভূমিকা পালন করেছে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ এবং সেই বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সামগ্রিক উন্নয়নের গর্বিত অংশীদার হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। পরিশেষে বলি, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একই সূত্রে গাঁথা; যা কেউ কখনো বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
লেখক: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়