রাজনীতি নয়, আসুন মানবিক হই: রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলি

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ
সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ  © টিডিসি ফটো

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৯ জনে পৌঁছেছে। নিহতের এই দীর্ঘ সারি আরও লম্বা হতে পারে! সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে, এটা একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নামক এক দাহ্য পদার্থের কারণে এই দুর্ঘটনা ভয়াবহ আকার লাভ করেছে এবং এতো প্রাণহানি ঘটছে। দুর্ঘটনার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি, চলছে। এই সময়ে আমাদের অগ্রাধিকার মানুষ বাঁচানোর, রাজনীতি নয়।

বছর কয়েক পর পর বাংলাদেশে এমন দুর্ঘটনা আবার হাজির হবে-এটাই সত্য। আমরা কিছু মানুষ, ফেসবুকে আবেগ হা-হুতাশ প্রকাশ করব, দুইদিন পর সব ভুলে যাব। একমাত্র স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কাছে এই দুর্ঘটনা দগদগে ঘা হয়ে থেকে যাবে। তারাই বুঝতে পারবে স্বজন হারানোর ক্ষত কত গভীর, কত মর্মন্তুদ!

বিএম কনটেইনার ডিপোর মূল মালিক হচ্ছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি সরকারের সিআইপি এবং স্মার্ট গ্রুপ, বিএম গ্যাস ও আল রাজী কেমক্যিালেরও মালিক। মুজিবুর রহমান সিআইপি তাঁরই ছোট ভাই এবং বিএম কনটেইনার ডিপোর একজন পরিচালক। পরিবারটি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শিল্প পরিবার। এই পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ চাকরি করে। রাজনৈতিকভাবে মুজিব ভাই আর আমার অবস্থান পুরোটাই ভিন্নমেরুতে। তাই স্বাভাবিকভাবে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতার প্রতিষ্ঠানে এত প্রাণহানি নিয়ে আমিও চাইলে সহানুভূতির আড়ালে রক্তগরম বক্তব্য উগড়ে দিতে পারি। এমন রাজনীতি চর্চায় ক্ষণিক উত্তেজনা তৈরি হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না, উল্টো হাজার হাজার মানুষের রুজি-রোজগারের প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় পড়ে যাবে। র্দুভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য যে, ইতোমধ্যে নিজ দলের একটি গোষ্ঠী এবং আমাদের মতো বিরোধী মতের একটি গোষ্ঠীও এই দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে এমন রাজনৈতিক চর্চা মোটেও কাম্য নয়। রাজনীতির এই সংকীর্ণ চর্চায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আজকের সীতাকুন্ডের ট্রাজেডিতে নিহত ও আহত হওয়া পরিবারগুলো। তাই আসুন মানবিক হই, সংকীর্ণতা ভুলে নিহত-আহত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াই।

রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতের অনুসারী হলেও এটা স্বীকার করতে হবে যে, মোস্তাফিজুর রহমান সিআইপি ও মুজিবুর রহমান সিআইপি দুজনই সজ্জন ব্যাক্তি। রাজনৈতিক বিভাজনের এই চরম সময়ে মুজিবুর রহমান সিআইপি জেলা আওয়ামী লীগের বড় পদে থাকলেও গত ১৪ বছরে দলীয় রাজনীতি চর্চার পরিবর্তে সর্বজনীন রাজনীতি চর্চা করেছেন। করোনাকালীনসময়সহ বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে তাঁরা দল-মত নির্বিশেষে চট্টগ্রামের বিশেষ করে বাঁশখালীর মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু?
সীতাকুন্ডে গত রাত থেকে যা হয়েছে তা পুরো বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিপর্যয়। এই ক্ষয়ক্ষতি কোনো সূচক দিয়ে প্রকৃতপক্ষে পরিমাপ করা সম্ভব না। ৪৯টি তাজা প্রাণ ইতোমধ্যে ঝরে গেল! ঝরে যাওয়ার এই মিছিল আরও কত লম্বা হয় তা একমাত্র আল্লাহই জানেন! লাশের দীর্ঘ মিছিল, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া কয়েকশত মানুষের যন্ত্রণা, স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি- তা কি দিয়ে পরিমাপ করবেন!! আর আর্থিক ক্ষতি সেটাও কাটিয়ে উঠার মতো না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এই অগ্নিকান্ডে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১১০ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার কোটি টাকার সমান। শুধু তাই নয় এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অগ্নিকাণ্ডে বারবার প্রাণহানি: বাংলাদেশের সক্ষমতা কি?
বছর কয়েক পরপর অগ্নিকান্ড-ভবনধ্বস-লঞ্চডুবি হাজির হবে আর অসংখ্য মানুষের প্রাণ যাবে- এটাই যেন নিয়তি, এটাই যেন আমার বাংলাদেশ...। দেশে উড়াল সেতু-ইট পাথরের কঙ্কাল নির্মাণের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হলেও সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা, নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির কার্যত কোন উন্নয়ন হয়নি। তাই বড় অগ্নিকান্ড বা দুর্ঘটনার সময় দেশের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জীবনরক্ষাকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দুর্বলতা ফুটে উঠে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে এসেও শুধুমাত্র এই সংস্থার বীরদের আন্তরিকতা দিয়েই সব সমস্যা সমাধানের পথ খুজি আমরা। ফলে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা থেকে শুরু করে বনানীর এফ আর টাওয়ার এবং সর্বশেষ সীতাকুন্ডের বড় অগ্নিকান্ডে নিজেদের কর্মীদের হারালো সংস্থাটি। যতদূর জেনেছি, এত বড় প্রতিষ্ঠানের ৬৪ মিটারের ল্যাডার রয়েছে মাত্র ২টি তাও ঢাকায় এবং সম্প্রতি কেনা হয়েছে। তেল বা কেমিক্যালজাতীয় পদার্থের আগুনে কার্যকর ওয়াটারমিস্টের সহজলভ্যতা এবং হ্যাজারডাস মেটারিয়ালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। খিচুড়ি রান্না শিখতে, আলুভাজি শেখার প্রশিক্ষণে কত বিদেশ সফরের কথা পত্রিকায় আসলেও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণের কোন সংবাদ আমাদের চোখে পড়েনি!

প্রস্তাবনা ও আসলে কি দরকার?
অগ্নিকান্ডে হতাহতের দায় কার এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হবে। সরকারের কোন মন্ত্রী এই অগ্নিকান্ডের পেছনে বিএনপির হাত আছে বলে দাবি করবেন আবার বিরোধী দল অগ্নিকান্ড ও হতাহতের দায় সরকারকে দিবে। কথিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিতে কয়েক শতাব্দী পার করবে। এভাবেই চলবে . . .। এর মধ্যে পদ্ধতিগত এসব দুর্ঘটনার কোন সমাধান আসবে না। তাই দোষারোপের রাজনীত, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের রাজনীতি বাদ দিয়ে আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। কারণ এসব সমস্যার সমাধানে দরকার রাজনীতির পুর্নগঠন ও জবাবাদিহিমূলক শাসন। এজন্য আসুন আগে রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলি। নিপীড়ক রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নাগরিক ভূমিকা পালন করি। অসহিষ্ণুতার পরিবর্তে পরমতসহিষ্ণুতা এবং বিভাজনের পরিবর্তে বহুত্ববাদের পক্ষে অবস্থান করি। তাহলেই মুক্তি সম্ভব! রাষ্ট্র মেরামতের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সবাইকে স্বাগত জানিয়ে সীতাকুন্ডের অগ্নিকান্ডের বিষয়ে আমি সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব পেশ করছি-

এক. বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডে নিহত ও আহত সবার পরিবারের ভবিষ্যত দায়িত্ব ডিপো কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। ইতোমধ্যে অবশ্যই কর্তৃপক্ষ এমন ঘোষণা দিয়েছে। সরকারকেও আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

দুই. জীবনরক্ষাকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে। ফোর্সেস গোল-২০৩০’র মতো বিশেষ ও জরুরী পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে।

তিন. ঢাকার মতো চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামে একজন ডা. সামন্ত লাল সেন দরকার যিনি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে এই কাজটি বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

চার. সকল শিল্প-কারখানায় প্রকৃত অর্থে সব ধরনের কমপ্লায়েন্স বা নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ঠ।

লেখক: শিক্ষক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ