ছাত্রদল নেতাদের বয়স এবং বাবা-চাচা তত্ত্ব
- হাবিবুর রহমান
- প্রকাশ: ৩০ মে ২০২২, ১২:৪৮ PM , আপডেট: ৩০ মে ২০২২, ০১:১০ PM
আজকেও ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ছাত্রদল নেতাদের বয়স নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের যুক্তি বয়স ত্রিশ পার হয়ে যাওয়ার কারণে তারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম ভাই মাইক্রোফোনের সামনে আসলেই এই তত্ত্ব দেন।
প্রথমত, আমি এবং সাদ্দাম ভাই একইদিনে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেছি৷ আমরা দুজনেই এখন অছাত্র বা সাবেক ছাত্র। কিন্তু তিনি নিজেকে কেন ছাত্র দাবী করেন জানি না। তার আইন অনুসারে তিনি ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবেন কিন্তু আমি পারব না। অথচ তিনি ভর্তি হয়েছেন ২০১১-১২ সেশনে কিন্তু আমি ভর্তি হয়েছি ২০১৫-১৬ সেশনে।
অছাত্র হওয়ার পরেও তিনি সহ তার সংগঠনের কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতারা আবাসিক হলে বসবাস করেন। কেউ কেউ আট দশ বছর ধরে হলে আছেন। সাদ্দাম ভাই এর ব্যাচের যারা ছাত্রলীগের নেতা আছেন তারা প্রায় সবাই দশ বছর ধরে হলে থাকেন। কেউ কেউ একা বা দুজনে একটা রুম দখল করে থাকেন৷ কিন্তু আমরা বাসা বা মেস থেকে এসে মধুর ক্যান্টিনে বসে চা খেয়ে আবার বাসায় ফিরে যেতে পারব না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে প্রতিরোধ করবে? আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের একরুমে ২৫-৩০ জনকে রেখে তারা দশ বছর ধরে আরাম আয়েশে বসবাস করছেন। তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হক কারা নষ্ট করছে ? সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হলে সেই ক্ষোভ কার উপরে থাকা উচিত? বাসা থেকে এসে মধুর ক্যান্টিনে দু'ঘণ্টা বসে যারা আবার বাসায় চলে যায় তাদের উপরে, নাকি যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সিট দখল করে রাখে তাদের উপরে ?
মাস্টার্সের রেজাল্ট পাবলিস হওয়ার পরেও যারা হলে থাকে তারা ক্যাম্পাসে অবৈধ বসবাসকারী। অবৈধ বসবাসকারীরা কীভাবে অন্য একজন সাবেক ছাত্রকে ক্যাম্পাসে আসা প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিতে পারে বুঝি না।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতির সেশন ২০০৩-০৪, সেক্রেটারির ২০০৫-০৬। ছাত্রলীগের সভাপতি সেক্রেটারির সেশন ২০০৮-০৯। ছাত্রদলের সভাপতির চেয়ে ৫ বছরের জুনিয়র, সেক্রেটারির চেয়ে ৩ বছরের। এখন তাদের থিওরি অনুযায়ী ২০০৮-০৯ সেশনের জয় ভাই আমাদের ভাই কিন্তু তার চেয়ে মাত্র তিন বছরের সিনিয়র ২০০৫-০৬ সেশনের জুয়েল ভাই 'চাচা'।
টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে, একক দখলদারিত্বের ক্যাম্পাসে রাজনীতি করেও তারা নিয়মিত ছাত্রদেরকে দিয়ে কমিটি গঠন করতে পারেনি। ২০০৮-০৯ সেশনের ছাত্রদের মাস্টার্স শেষ হয়েছে ২০১৩/১৪ সালে। নয় বছর আগে তাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হওয়া যদি ছাত্রত্ব ধরে রাখা হয় তাহলে ছাত্রদলের নেতারাও সবাই কোনো না কোনো কোর্সে ভর্তি আছে। একটা দল ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকেও আট নয় বছর আগের প্রাক্তন ছাত্রদেরকে দিয়ে সংগঠন চালাচ্ছে। সেখানে আরেকটা দল ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। কোনো হলে একজন কর্মী থাকতে পারে না, ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি দশ বছর। দশ বছর ক্যাম্পাস থেকে দূরে থেকে নিজেদের টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতে হয়েছে। হামলা-মামলা, কোর্ট - হাসপাতাল নিত্যসঙ্গী। এরকম একটা সংগঠনের নেতাদের বয়স ০৩-০৫ বছর বেশি হওয়াতে এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে যে তাদেরকে ক্যাম্পাসে আসতে দেওয়া যাবে না।
সাদ্দাম ভাই নতুন একটা তত্ত্ব বের করেছেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্রে প্রার্থী হওয়ার বয়স ত্রিশ। তাই ত্রিশের বেশি বয়স হলে সে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবে না৷ তার কথাই হচ্ছে ডাকসুর গঠনতন্ত্র ছাত্ররাজনীতির মানদণ্ড। এখানে অনেকগুলো ফ্যালাসি আছে।
প্রথমত, ডাকসুর গঠনতন্ত্র হচ্ছে কে ডাকসুর প্রার্থী আর ভোটার হবে তার মানদণ্ড। ছাত্রসংগঠনের নেতা হতে কী কী মানদণ্ড লাগবে তা ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোনো আইনে নাই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আদেশ, ১৮টা স্ট্যাটিউট, অর্ডিন্যান্স কোথাও বলা নাই যে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে হলে বয়সসীমা এরকম হতে হবে। ডাকসুর গঠনতন্ত্রে এই বিষয়টি এসেছে ২০১৯ সালের শুরুতে যখন গঠনতন্ত্রের ৮ এর ই ধারা সংশোধন করা হয়। ২০১৯ এর আগে ডাকসুর জন্যও কোনো বয়সসীমা ছিল না। ২০১৯ সালের ডাকসুর জন্য সিনেটে পাশ করা একটা বিধান হঠাৎ করে দুই বছরের মাথায় ছাত্ররাজনীতির মানদণ্ড কীভাবে হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আর মানদণ্ড হয়ে গেলে তার সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিরও রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাদের বয়স ত্রিশ পার হয়ে গেছে।
ছাত্রলীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখনকার দুইটা অবস্থা দেখাই। জনাব মনিরুজ্জামান বাদল আততায়ীর গুলিতে ক্যাম্পাসে খুন হন। তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন৷ শামসুন নাহার হলের সামনে তার ভাস্কর্য আছে। সেখানে গেলে দেখবেন তার জন্ম ১৯৫৫ সালে এবং মৃত্যু ১৯৯২ সালে। অর্থাৎ তিনি ৩৭ বছর বয়সে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ক্যাম্পাসে সক্রিয় রাজনীতি করে গেছেন৷ আবার উল্টোদিকে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ২৭ বছর বয়সে ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট এবং ৩৩ বছর বয়সে এমপি হয়েছিলেন।
২০০২ সালের কাউন্সিলে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন লিয়াকত শিকদার এবং সাধারণ সম্পাদক হন নজরুল ইসলাম বাবু। লিয়াকত শিকদার ঢাকা কলেজের এবং নজরুল ইসলাম বাবু জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ তারা নিয়মিত মধুর ক্যান্টিনে এসে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতেন। কিন্তু এখন ছাত্রদলের অন্য কোনো ইউনিটের কেউ মধুর ক্যান্টিনে আসলেই ছাত্রলীগের নেতারা সরব হয়ে উঠেছেন- ’বহিরাগত, বহিরাগ ‘ বলে। অথচ তাদের সংগঠনের বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে। রাজনীতি করেছেন মধুর ক্যান্টিনে।
নজরুল ইসলাম বাবু তিনবার এমপি হয়েছেন। তার জন্মতারিখ ১০ মার্চ ১৯৬৭ সালে। তিনি যখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি হন তখন তার বয়স ৩৫ বছর। ২০০৬ সালে ৩৯ বছর বয়সে দায়িত্ব ছাড়েন। এখন তার উপরে যদি জয় ভাই, সাদ্দাম ভাই এর থিউরি এপ্লাই করা হয় তাহলে আমরা কী বলতে পারি ?
আরও কাছাকাছি আসি। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি দাদা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসএসসির মার্কসিটে তার জন্মতারিখ ২২ জুন, ১৯৮৭। সেই হিসেবে আজকে তার বয়স ৩৪ বছর ১১ মাস ০৭ দিন। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে ভাই ডাকা হয় না চাচা ডাকা হয়, জানি না।
অন্য দলের সাংগঠনিক নীতির বিষয়ে নজর না দিয়ে নিজ দলের বর্তমান এবং অতীতের দিকে তাকান। এখানে শুধু বয়সের হিসাব দেখালাম। আপনারা যতগুলো স্ট্যান্ডার্ড সেট করছেন আর যতগুলো অভিযোগ আনছেন সেই স্ট্যান্ডার্ডে আপনাদের আমলনামা যাচাই করলে আপনাদেরও ক্যাম্পাস রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে। যেমন: বারবার বলেন মামলার আসামি হওয়ার কথা। এমপি পদে মনোনয়নের জন্য যে হলফনামা দিতে হয় তা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আছে। সেখানে জীবনে যতগুলো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছে তার বিবরণ দিতে হয়। সেখান থেকে দেখলাম ছাত্রলীগের একজন সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ছয়টি হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
হাবিবুর রহমান
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়