ক্যাম্পাস পুলিশ চালু করা জরুরি
গত কাল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে রাবার বুলেট ছোড়া, টিয়ার সেল নিক্ষেপ, কিংবা পুলিশের লাঠি চার্জের ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ইউটিউবে দেখলাম। যা আমাকে ব্যথিত করেছে। মনে পড়েছে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সময়ের কথা। বিশেষ করে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে আমার বন্ধু আবু বকর নিহত হওয়ার কথা।
ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় আবু বকর নিহত হয়। তার মাথার পেছনে ভারি কিছুর আঘাতে সে মারা যায়। ওই সময় হলের ছাত্ররা দাবি করেছিল, টিয়ার সেলের আঘাতে তার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু এ হত্যার আসল রহস্য আজো উন্মোচিত হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল তারা সবাই খালাস পেয়ে যায়। কিন্তু একটি মায়ের বুক খালি হয়। একজন ভাই তার ভাইকে হারায়। বাবা হারায় সন্তান।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ কিংবা মারামারির ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। একদল শিক্ষার্থী চাইলেই অন্য দলের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে। পিটিয়ে পংগু করে দিতে পারে। দোতলা বা তিন তলা থেকে ফেলে দিতে পারে। দলীয় ছত্রছায়ায় রাম রাজত্ব কায়েম করাই ক্যাম্পাস রাজনীতি। তাই এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে কাছাকছি সময়ে শেষ হচ্ছে বলে মনে হয় না। যারা ক্যাম্পাস প্রশাসক তারাও বিষয়টি নিয়ে অনেকটাই উদাসীন। এর বিরুদ্ধে কিছু বললে তাদের চেয়ার হারানো ভয় আছে। তাই তারাও চুপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্যাম্পাস রিপোর্টার হিসেবে প্রায় ৬ বছর কাজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করলেও বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, ঢাকা মেডিকেল, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সংবাদ আমাদের কাভার করতে হত। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের বিশেষ বিশেষ ইভেন্টের পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি কিংবা শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়েই রিপোর্ট করতাম।
তবে এসব ক্যাম্পাসের ছাত্র নির্যাতন, গ্রুপিং কেন্দ্রিক সংঘাত, কিংবা মারামারি সংক্রান্ত সংবাদগুলোও আমাদের সংগ্রহ করতে হত। তখন শাহবাগ থানা, ধানমন্ডি থানা, নীলক্ষেত পুলিশ ফাড়ি, ক্যাম্পাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ফলে আন্দোলন দমনের রাজনীতি খুব কাছ থেকে দেখেছি। যেখানে সব সমই সাধারণ ছাত্রদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হত।
আরও পড়ুন: সংঘর্ষে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে: অধ্যক্ষ
ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ের দৈনিক যুগান্তরে কয়েকটি প্রতিবেদক করেছিলাম। তখন ক্যাম্পাস পুলিশের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। কেননা ইতোমধ্যে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে পুলিশের বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে। যেমন পর্যটকদের সেবায় টুরিস্ট পুলিশ বা গার্মেন্টস আন্দোলন ট্যাকেলে শিল্প পুলিশ। এছাড়াও আছে রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ বা নৌ পুলিশ।
তা হলে ক্যাম্পাস পুলিশ নয় কেন? ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাস পুলিশ চালু করা জরুরি। যেসব পুলিশ অন্য পুলিশের মত নির্বিচারে ছাত্রদের উপর রাবার বুলেট ছুড়বে না, টিয়ার শেল ছুড়বে না, পিটিয়ে মাটিতে শুয়ে দেবে না। যারা ছাত্রদের সেন্টিমেন্ট বুঝে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। যারা বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েই ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালনে আসবে। যারা হবে শিক্ষার্থী বান্ধব।
বর্তমানে আমি পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্ত্ররাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছি। এখানে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার দায়িত্বে ক্যাম্পাস পুলিশ আছে। যাদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি তাদের জীবন মানের উন্নয়ন ঘটানো। যে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের সেবায় কাজ করবে। আসলে এরা শিক্ষার্থী বান্ধব পুলিশ। শিক্ষার্থীরা কোন সমস্যায় পড়লে এদেরই ফোন করে। এরাই এগিয়ে আসে সবার আগে।
এদের সেবার একটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করব। আমার এক বন্ধুর গাড়ি শীতকালে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রী তাপমাত্রা রাস্তায় বন্ধ হয়ে যায়। সে কোনভাবেই গাড়ি থেকে বের হতে পারছিল না। বাইরে প্রচন্ড বরফ পড়ছিল। সে ৯১১ এ ফোন দেয়। ক্যাম্পাস পুলিশ এসে তাকে গাড়ি থেকে বের করে। তার গাড়ি চালু হতে সাহায্য করে। বাসায় পৌছে দেয়।
অন্যদিকে আইন অমান্য করলে মামলা দিতেও দেরি করে। ক্যাম্পাসে যারা ড্রাইভিং করে তারা আইন ভংগের কারনে মামলা খায় নাই এই রেকর্ডও নাই। আসলে সে তার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। কে কোন দেশ থেকে এসেছে তা দেখে না। কিংবা কে কোন দলের কর্মী তাও দেখে না। তাই দায়িত্বশীল মহল ভেবে দেখতে পারেন ক্যাম্পাস পুলিশের বিষয়টি। শিক্ষার্থী বান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণে এটা একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। আপনারা একটু ভেবে দেখবেন কি?
লেখক: পিএইচডি গবেষক, গ্রান্ড ফোর্ক্স, যুক্ত্ররাষ্ট্র