হলে সিট দিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য নেয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন
ক্লাস শেষে অফিস রুমে বসে ছিলাম। এমন সময় একটি ছাত্র কাঁচুমাঁচু ভংগীতে এসে ঢুকলো। বললো যে ক্লাসে দেরী করে আসায় এটেনডেন্স দিতে পারে নাই। জিজ্ঞেস করলাম দেরী হলো কেন? স্যার, গতকাল হলে বড় ভাইরা অনুষ্ঠান করছে। রাত চারটা পর্যন্ত প্রোগ্রাম চলছে।
ঢাবি তথা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হলগুলো যেভাবে চলে আমার ধারণা পৃথিবীর আর কোন ছাত্রাবাস এইভাবে চলে না। হলের ছেলেদের সাথে তাই এই বিষয়ে আমি প্রায়ই বিভিন্ন কিছু জানতে চাই। আমি ছাত্রটিকে বসতে বললাম আরেকটু বিস্তারিত জানার জন্য।
আরও পড়ুন: ঢাবির এফ রহমান হল শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ কর্মীর চড়-থাপ্পড়
হলে কবে উঠেছ? স্যার, এই তো ভর্তি পরীক্ষায় সাবজেক্ট পাওয়ার পর গ্রামেই ছিলাম, তখন এলাকার এক পলিটিক্যাল বড় ভাই যোগাযোগ করে। (বলাবাহুল্য পলিটিক্যাল বড় ভাই আর ছাত্রলীগ সমার্থক)
বড় ভাই তোমার খোঁজ পেলো কি করে? হলে যখন ছাত্রদের লিস্ট যায় তখন যেই বড় ভাইয়ের যেই অঞ্চলের দায়িত্ব থাকে সে সেই অঞ্চলের ছাত্রদের খুঁজে বের করে হলে উঠায়।
বড় ভাইরা এই মহান দায়িত্ব কেন পালন করে? যেই ভাই যত ছাত্র আনতে পারবে সে তত বেশী ম্যান পাওয়ার দিতে পারবে মিছিল মিটিং সমাবেশ এইসব করার জন্য। তখন দলে তাঁর অবস্থান, পাওয়ার বাড়বে।
বড় ভাই যোগাযোগ করার পর কি করলা? ঢাকায় এসে হলে সেই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম। ভাই একটা গণরুমে পাঠিয়ে দিলো।
ব্যস, ভাই বললো আর তোমার হলে থাকা শুরু হয়ে গেলো? এই হলের দায়িত্বে থাকা প্রক্টর, হাউস টিউটর কারো সাথে কখনো তোমার দেখা হয় নাই? না।
আরও পড়ুন: ৫ মাসে ঢাবির হলে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার দেড় ডজন শিক্ষার্থী
ভাবলাম, কি তামশা, একটা জলজ্যান্ত ছাত্র একটা আবাসিক হলে উঠে গেলো প্রশাসনিক কোন প্রক্রিয়া ছাড়া। তোমাদের হলের প্রভোস্ট বা কোন হাউজ টিউটরের নাম জানো? না।
যা বোঝা গেলো তা নতুন কিছু না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলোগুলোতে বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশাসনিক কাঠামো নাই। হলগুলোর দায়িত্ব পুরোপুরি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ ছাত্র সংগঠনের থাকে।
তাঁরা আবাসিক সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক আনুগত্য আদায় করে সদ্য আগত নিরীহ ছাত্রদের। রাত নেই দিন নেই বড় ভাইয়ের নির্দেশে মিটিং মিছিলে হাজিরা দিতে হয়। অমান্য করলে চলে গেস্টরুমে অত্যাচার।
এই কাঠামোর মূল উদ্দেশ্য হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে রাখা। যেইজন্য দরকার পেশীশক্তি আর এই পেশীশক্তির যোগান দেয় আবাসিক সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে কিনে নেয়া এই আনুগত্য।
আরও পড়ুন: ঢাবির বিজয় একাত্তর হলের সিট নিয়ন্ত্রণেও ছাত্রলীগ
প্রশ্ন হলো এই পুরো প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের ভূমিকা কি? তাঁরা কি কারণে এইসব প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর এইসব পদ পদবীতে আসেন? একটা বাড়ি, একটা পদ পেয়েই দায়িত্ব শেষ?
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত যে নিপীড়ন,অত্যাচার ঘটে তাঁর পুরোটাই ঘটে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশীরভাগ শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে। আবরার খুন হয়, এহসানের চোখ কানা হয় এইসব শিক্ষকদের কারণেই। এনারা হালুয়া রুটি পেয়ে খুশী অথবা কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে মাস শেষে বেতন পেয়েই খুশী। এরকম খুশির পরিবেশ আর কেই বা বদলাতে চায়?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়