২৫ জুন ২০২১, ১৭:৩৬

মডেল মসজিদ হচ্ছে, মন্দির হবে না কেন!

সজীব ওয়াফি  © ফাইল ছবি

দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ বাস্তবায়ন হচ্ছে। আশার খবর- ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সেখানে আগের তুলনায় নিশ্চিতে শান্তিতে ইবাদত করতে পারবেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় স্থায়ী মন্দিরের সংখ্যাও হাতেগোনা, বলতে গেলে অনেকটা জীর্ণশীর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মডেল মন্দির নির্মাণেরও দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের এবং মতের মানুষ একে অপরকে জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে। জনসংখ্যা বিবেচনায় মুসলমানদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে হিন্দু সম্প্রদায়।

পুজোর সময়ে মুসলিম ছেলে-মেয়েরা যেমন পুজোয় যায়, হিন্দু ধর্মীয় বন্ধুদের কাছে নাড়ু খাওয়ার আবদার ধরে; ঠিক তেমনি ঈদের সময়েও হিন্দু ছেলে-মেয়েরা ইসলাম ধর্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে আসে। ধর্মটা কিন্তু এখানে প্রধান নয়। প্রাধান্য পাচ্ছে উৎসবটা, সম্প্রীতিটা।

পড়ুন: প্রতি উপজেলায় মডেল মন্দির চায় হিন্দু মহাজোট

কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটা সময় বাংলাদেশ পিছনে ফেলে এসেছে বহু আগেই। হিন্দুদের বাড়ির উপর থেকে মুসলমান কেউ চলাচল করলে গোবর-পানি ছিটিয়ে রীতি ছিল পবিত্র করার। আবার খেলারছলে মুসলমান শিশুরা লাল পিঁপড়া মেরে ফেলত। কারণ কামড়ায় বলে লাল পিঁপড়াকে হিন্দু এবং কালো পিঁপড়াকে মুসলমান ভাবতো তারা। শিক্ষা সেই কুসংস্কার ক্রমশই দূর করে সব ধর্মের মানুষকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতে পেরেছে। নিয়ে আসতে পেরেছে পাশাপাশি বসে খাওয়া দাওয়াতে।

আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নতমানের মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। উদ্দেশ্য ইসলামের সত্যিকারের মর্মবাণী প্রচার করা। বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়।

সারাদেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। শুরুতে সৌদি আরবের অর্থায়নের কথা থাকলেও নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামি ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়িত করেছে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর।

মডেল মসজিদ

পদ্মা সেতুর পর নিজস্ব অর্থায়নে এটা সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যয় বরাদ্দ প্রকল্প। বিশ্বের ইতিহাসে একসঙ্গে এত মসজিদ নির্মাণের ঘটনাও নজিরবিহীন। অথচ যখনই হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের দাবি উপস্থাপন করেছেন, একটা পক্ষ মিথ্যা তথ্যের ট্যাটা বল্লম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে তারা প্রচার করেছে ‘মডেল মসজিদ সৌদির অর্থায়নে হয়েছে/মন্দির নির্মাণে ভারত অর্থ দেউক’।

সত্যি কথা বলতে মসজিদ নির্মাণে সৌদি আরবের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মসজিদ যদি সৌদির চ্যারিটি অর্থায়নেও হয়, মন্দিরের প্রশ্নে কেন ভারত আসবে! এটা কি ইসলামের শিক্ষা? হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কি ভ্যাট ট্যাক্স দেয় না? নাকি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও শান্তিতে উপাসনা করুক এটা তারা চায় না?

পড়ুন: সমাজকে ব্যাধিমুক্ত রাখবে মডেল মসজিদ: প্রধানমন্ত্রী

অনুন্নত হলেও ইবাদতের জন্য আমাদের মসজিদগুলোর আছে একটা স্থাপনা। কিন্তু মন্দিরগুলো অর্থের অভাবে অনেকাংশেই অস্থায়ী। উপাসনার জন্য স্থায়ী কিছু সংখ্যক মন্দির থাকলেও বেশিরভাগেরই বেহাল দশা। গত শতাব্দীর পুরোনো মন্দিরগুলোতে পলেস্তারা ছুটে পরার মত। সরকার থেকে কিছু উদ্যোগ নিলেও প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে উপাসনা করার মডেল কোন মন্দির হয়নি, যেখান থেকে ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মত সনাতন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটবে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। মৌখিকভাবে মুসলমান জনসংখ্যা ৮০ শতাংশ হলেও বাস্তবে সেটা আরো বেশি। জনসংখ্যার এই দাপট দেখতে হচ্ছে প্রায়ই সময়েই। রাতের অন্ধকারে মন্দির ভেঙ্গে ফেলার দৃশ্য মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় বাস্তুভিটায় কোন উগ্রবাদী মহল আগুন লাগিয়ে দিলে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও একটা গোষ্ঠী গাছকে মুসলমানীকরণ করেছে। ‘থাকলে ভোট পাবে/ গেলে জায়গা পাবে’ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এমনটাও প্রকাশ করে মাঝে মাঝেই। মুখ বুজে সহ্য করতে হয় নানান কার্যকলাপ। ফলাফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমশই হচ্ছে ভারতমুখী।

বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সব ধর্মের এবং মতের মানুষজন এখানে সম অধিকার পাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পুজোয় কোনদিন যায়নি এরকম মুসলিমের সংখ্যা নগন্য। অথচ ধর্মীয় সংঘাতের যে সম্ভাব্য ঢেউ আসতেছে এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিদ্বেষ না ছড়িয়ে ইসলামের মর্মবাণী আমাদের মানবিক করুক। মডেল মসজিদের পাশাপাশি মন্দিরের বাস্তবায়ন সম্প্রীতি রক্ষার দাবি, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক বিস্তারের দাবি।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক