১০০ বছরে ঢাবি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ৫০ বছর

রোকেয়া হলে র‌্যাগডে চামেলী হাউসের বাঁ দিকে নিচে অফিস কক্ষের (মাধবীলতা গুচ্ছের) সামনে
রোকেয়া হলে র‌্যাগডে চামেলী হাউসের বাঁ দিকে নিচে অফিস কক্ষের (মাধবীলতা গুচ্ছের) সামনে  © ফাইল ফটো

১৯২১ সালে ঢাকা বাংলা বিভাগ ছিল না। ছিল ‘সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ’। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহই বাংলা স্নাতক শ্রেণির পাঠক্রম করেন। ১৯৩৭ সালে সংস্কৃত বিভাগ ও বাংলা বিভাগ আলাদা হয়ে যায় আর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। সে সময় যে মনীষী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষকেরা বাংলা বিভাগ আলো করেছিলেন তাঁরা হলেন মোহিতলাল মজুমদার, ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ডক্টর মনোমোহন ঘোষ, কবি জসীমউদ্‌দীন, মুহম্মদ আবদুল হাই প্রমুখ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এবং তার পরে নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমাদের বাংলা বিভাগ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।

রোকেয়া হলের সে প্রাচীন বাড়িতে এক সময় নাকি গান আর পান হত। নূপুরের রিন রিন শব্দ নীলক্ষেতের ধানিজমির হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খেত। আর রাতের বেলা এ রহস্যময় বাড়িটির কাঠের সিঁড়িতে শোনা যেত ঔপনিবেশিক আমলের সাহেবদের ভারি জুতোর শব্দ। কিন্তু সেই চামেলী হাউস নামের এমন ভূতুড়ে স্থাপনায়ই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাড়িটির গায়ের ফাটল দিয়ে উঠে গেছে পরগাছা, বিশাল স্নানঘরের ছাদ চুইয়ে নেমে আসছে জলধারা। বাইরে চামেলী গাছ না থাকলেও গাড়ি বারান্দার ওপরে ছিল আর্শ্চয মিষ্টি এক ম্যাজেন্টা রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ মাধবীফুল আর তার লতার লাস্য। ১৯৫৭ সালে রোকেয়া হল নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল ছাত্রী নিবাস।

আর আমরা সেসব গল্প শুনতে পেয়েছি মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডক্টর আহমদ শরীফ, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, নীলিমা ইব্রাহীম, আনোয়ার পাশা, সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার এঁদের কাছ থেকে। শুনেছি আমাদের সময়ের কলা ভবনের এই বিদ্যাদেবদের কাছ থেকে, একেবারে তাদের সামনে বেঞ্চে বসে বসে। কখনো বিশাল ২০১৭ নম্বর কক্ষে, কখনো শীতের রোদে হেলান দিয়ে বাংলা বিভাগের করিডোরে, কখনো আসন্ন উৎসবের জন্য ডি এল রায়, রবীন্দ্রনাথ কিংবা কাজী নজরুল ইসলামের গানের মহড়া দিতে দিতে অধ্যাপক আব্দুল হাই স্মৃতি পাঠকক্ষে মেঝেতে বসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ওঁরাই প্রাচ্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় করে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই অসামান্য শিক্ষাগুরুদের জ্ঞান কলস আমাদের হতভাগ্য মাথায় উপুড় হবার আগেই ১৯৭১ সালে তাঁদের ক’জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগী হন্তারা। আমাদের প্রাণপ্রিয় পিতৃতুল্য শিক্ষকদের ওরা হত্যা করে ঠিক বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে।

১৯৬৯ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই তখন শহীদ মুনীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। ভর্তি হয়েই রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী হবার জন্য আবেদন করে বাসে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে ক্লাশ করে আবার ফিরে যাচ্ছিলাম। আব্বা তখন নারায়ণগঞ্জে খাদ্য বিভাগে টাউন রেশনিং বিভাগের প্রধান। আমি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা যিনি আরপি সাহা নামে পরিচিত ছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত টাঙাইল কুমুদিনী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি। হলের এম এ শেষ বর্ষের ছাত্রীদের সেশন যেকোন কারণে শেষ হয়নি বিধায় তারা হল ছাড়েননি। এদিকে প্রথম বর্ষের ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। কি করা! ঐ শেষ বর্ষের কোনো একজনের সঙ্গে ডাবলিং করার শর্তে আমার প্রবেশ হল চামেলী হাউসে। আমি ভেবেছিলাম প্রভোস্ট আপা আমাকে ছোটবেলায় চিনতেন বলে একটা পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। পরে বুঝলাম এটা একটা চালু সিস্টেম। কেবলমাত্র ভীষণ মেধাবীরাই শুরু থেকে একক সিট পায়।

তখন সাময়িকভাবে রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সৈনিক ডক্টর সাফিয়া খতুন। একটু লক্ষীট্যাঁরা, সৌম্য কান্তি, সাদা শাড়ি সরু পাড় ও চোখে আয়তাকার কালো ফ্রেমের চশমা ও হাতে বিশাল হ্যান্ডব্যাগ। আমি ক্লাশ ফাইভে নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলে ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখানে তিনি মেয়েদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য পুরো স্কুলকে ১০টি হাউসে ভাগ করে দিয়েছিলেন। আমি ছিলাম রানী ভবানী হাউসে।

রোকেয়া হলে ঢোকা বলে কথা! সে ডাব্লিং আর ট্রিপ্লিং হোক। আমি শামীম তরফদার (১৯৭২ সাল থেকে আজাদ), আবু আহমদ মাহমুদ তরফদার ও আনোয়ারা তরফদারের কন্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়বো সেই সুলতানার স্বপ্নের রোকেয়া হলের আদি দালানে থাকবো! পুলকে প্রায় পাগল হয়ে গেলাম।

আমার চুলে তখনও কুমুদিনী কলেজের মফস্বলী পবিত্রতা। ক্লাশে শাড়ি, চুলে দুই বেনী, গায়ে অড্রে হেপবার্ন স্টাইলের একটা আঁটোসাঁটো পাকা পিচরঙা প্রিন্ট কামিজ পরি, ফেরিওলার ঝুড়ি থেকে পাঁচ টাকায় কেনা দুই স্ট্রাপ স্যান্ডেল। তুললাম নিউ মার্কেট থেকে পাসপোর্ট সাইজের ছবি। ছবিটা ফাইলে ঢুকল আর আমি রোকেয়া হলে রেসিডেন্ট স্টুডেন্ট হিসেবে বিশাল এক টিনের গেটের ভেতরে প্রবেশ করলাম।

ততদিনে স্থায়ী প্রভোস্ট আপা এসে গেছেন। হল কম্পাউন্ডের ভেতর তাঁর কোয়ার্টার। দারুণ কড়া প্রভোস্ট আখতার ইমাম। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, নিত্য নতুন বন্ধু, কিংবদন্তী শিক্ষক, বিদেশি পিঠস্থানের মত অপূর্ব সুন্দর ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, চারিদিকে কেবলই নবীনবরণের ধুম। একবার রোকেয়া হলের বিশাল গেটের ফোকর গলে বাইরে বেরুলে আর হলে ফিরতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তাঁর ভয়ে পড়িমরি করে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার আগে হলের গেটের ভেতর ফিরে আসতে হয়। হাজিরা দিতে হয়। তখন আবার সন্ধ্যার পর আরেক বায়োস্কোপ জীবন! হলের বিভিন্ন স্থাপনার একটি থেকে অন্যটিতে কেবল যাওয়া আর আসা। আড্ডা-গান-দৌড়াদৌড়ি পুকুর পাড়ে বসে প্রেমের গল্প, অকারণে খিলখিল, বাতাসে বাতাসে শাড়ির পতাকা। কিন্তু আপার গাড়ির হর্ণ আর নমীদার গেট টানা ঘরঘর শোনা মাত্র যে যেখানে আছি সেখানেই তার ধাতব ভাস্কর্য হয়ে যেতে হতো।

সবসময়ই সেই তিমি মাছের পেটরঙা শীতল সেই বিশাল গেটে পালাক্রমে থাকতেন মহাপরাক্রমশালী দু’জন দারোয়ান।আমরা সামনের রাস্তায় রোডের হার্ড শোল্ডারে সারি সারি বেগুনী জারুল গাছের নিচে বসে শেষ আড্ডা সময় পার করে সাড়ে ৭টার দু‘এক মিনিট দেরি করলেই রুদ্ধ সে গেটের গায়ে মৃদু টংকার তুলে তার দরোজা খোলার জন্য কত যে অনুনয় করতে হতো! কখনো বাইরের আড্ডা শেষে হলে পৌঁছে দিতে এসে হাসান, রেজা, বাহার মজা করে পুরানো প্যারডিটাই বার বার করতো; রোকেয়া হলের গেট দেখেছ দেখ নাই তার প্রাণ/ ভেতরে তার শত শত নারী/ বাহিরেতে দারোয়ান!

গেটের ভেতর দু‘পাশে ছিল বারান্দা ও চৌকো পিলারওলা ভিজিটরস রুম। বাঁ দিকে তার পেছনেই র্দীঘ শিরীষের সবুজ ছায়া ও শীতল পুকুর। চামেলী হাউসের নিচের তলায় হল অফিস, প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের কক্ষ। ১৯২১ সালে অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজের কন্সেপ্টে এই হাউস টিউটর পদ্গুলো করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের হাউস নয় ছিল হল। এবং তারা আমাদের পড়াতেন না। কেবল দাপ্তরিক কাজ, আমাদের হাজিরা নেওয়া ও ধমকাধমকিই করতে দেখতাম।

স্টাফ কোয়ার্টার, জালি দেয়া দেয়ালের ডাইনিং হল, স্টাফ কোয়ার্টার হল, মেইন বিল্ডিং সবকিছুর মধ্যস্থানে ছিল কমনরুম। ভেতরে টেলিভিশন, ফ্রি সংবাদপত্র, একটি হারমনিয়াম ও জোড়া তবলা-বায়া। কার্পেটে বসে রাতে দেখি লিন্ডসে ওয়েগনার অভিনীত টিভি সিরিজ ‘বায়োনিক উয়োম্যান’। কমনরুমটি ডিজাইন করেছিলেন কোনো এক বিদেশি রোমান্টিক আর্কিটেক্ট। রুমের মধ্যখানটা ফুঁড়ে ছিল এক বিশাল বনষ্পতি বৃক্ষ। বৃষ্টি এলে সে গাছের গা জড়িয়ে থাকা চিরহরিৎ টাকা-গাছের বাকলের ফাটল বেয়ে যে রূপালী জলধারা ঝরতো সব দেখা যেতো আয়নার মতো। আর কাঁচের এপাড়ে আমার রুমমেট শ্রাবণী হারমনিয়াম টেনে গাইতে বসতো বর্ষার গান।

 

(চলবে)

শামীম আজাদ: কবি ও লেখক
লন্ডন
lekhok@gmail.com