প্রেসিডেন্টের পদ প্রত্যাখ্যান ও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় আইনস্টাইনের ভূমিকা

আলবার্ট আইনস্টাইন
আলবার্ট আইনস্টাইন  © ফাইল ফটো

আলবার্ট আইনস্টাইনকে বলা হয় পৃথিবীর সর্বকালের সেরা কিছু মেধাবী বিজ্ঞানীদের একজন। ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া এই বিজ্ঞানীর সাথে যুক্ত আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক সত্যেন বোসের নাম। আইনস্টাইনের জীবনের ৯টি সেরা কাজের দুটিই অধ্যাপক বোসের সাথে। নোবেলবিজয়ী প্রথম বাংলাভাষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সুসম্পর্কের কারণেও বাংলাদেশ ও ভারতে আইনস্টাইন জনপ্রিয় এক সামাজিক মুখ। কিন্তু বিজ্ঞানীর বাইরেও আইনস্টাইন তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ডের জন্যও এক আলোচিত ব্যক্তিত্ব। ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর তাঁকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। যদিও ইসরায়েলিরা তাঁকে দিয়েছে জাতীয় নায়কের সম্মান। প্রশ্ন ওঠে তিনি কি জায়নবাদের সমর্থক ছিলেন কিনা? নাকি ইহুদীদের উপনিবেশিক প্রকল্প ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিলেন?  এই লেখায় আমরা সে বিষয়টি আলোচনা করবো।

আলবার্ট আইনস্টাইন জন্ম নেন জার্মানির দানিউব নদীর তীরের ছোট্ট শহর ওলমে। জার্মানিতে সে সময় বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে সেবা দিতে হতো। মূলত সামরিক বাহিনীর সার্ভিস এড়াতেই তিনি ১৭ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব নেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানির যুদ্ধ অভিলাষকে যখন ৯৩ জন প্রথিতযশা জার্মান চিন্তাবিদ সমর্থন দিয়েছিলেন তখন আইনস্টাইন আরও দুজনকে নিয়ে শান্তির পক্ষে ‘কাউন্টার মেনিফেস্টো’ দিয়েছিলেন। জার্মান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর তিনি জার্মানির পূর্ণ সমর্থনে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীতে জার্মানির সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক পূননির্মাণেও কাজ করেছেন। হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিব্যাপী ইহুদীবিরোধী ঘৃণার শুরুতে ১৯৩২ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকান সরকারকে অনুরোধ করে অনেক ইহুদির ভিসার ব্যবস্থা করে ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। ১৯৩৩ সালে তিনি জায়োনিস্ট সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন এবং ইন্টারন্যাশনাল রেস্কিউ কমিটি গঠন করেন। আইনস্টাইন ছিলেন লেবার জায়নিজমের সমর্থক যারা মনে করতেন বড় কোনো রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন হতে পারে কেবল ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদিদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করার মাধ্যমেই।

আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় দেশের চার বিশ্ববিদ্যালয়

রাশিয়ায় বলশেভিকদের উত্থানের সাথে সাথে লেবার জায়নিজম আমেরিকার বাম ও আন্তর্জাতিকতাবাদীদের বেশ সমর্থন আদায় করে নিয়েছিল। বলা বাহুল্য আইনস্টাইন নিজেও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রচারক ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথকেও দলে ভিড়িয়েছিলেন। কিন্তু লেবার জায়নিজম ১৯৩০ সালের মধ্যেই রাজনৈতিক জায়নিজমের সাথে মিশে যায়।

ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের ব্যাপারে আইনস্টাইন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি কিছুটা নিমরাজি ধরণের ইউটোপিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন।

১৯৩৮ সালে “আওয়ার ডেট টু জায়োনিজম” শিরোনামের এক বক্তৃতায় আইনস্টাইন বলেন, ‘আমি ইহুদীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চেয়ে বরং একটি যৌক্তিক চুক্তির মাধ্যমে আরবদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকেই প্রাধান্য দেই। আমি ইহুদী ধর্মের মৌলভিত্তি যতটুকু বুঝেছি তা হলো ইহুদী ধর্ম বর্ডার, আর্মি ও শক্তি দিয়ে তৈরি কোনো রাষ্ট্রের ধারণার পরিপন্থী। আমি ইহুদী ধর্মের ভেতরকার ধ্বংস নিয়ে বিচলিত যেটি সরু জাতীয়তাবাদ দ্বারা সৃষ্ট যার বিরুদ্ধে এমনকি নিজেদের রাষ্ট্র না থাকার পরেও আমরা অতীতে যুদ্ধ করেছি। যদি এমন কোনো পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্র তৈরিতে বাধ্য করে তাহলে আমরা যেন সেটা সময় এবং কৌশল নিয়ে ধৈর্য সহকারে করি।’

১৯৪৬ সালে যখন ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্রের সম্ভাব্যতা নির্ণয়ে অ্যাংলো-আমেরিকান কমিটি অব ইনকোয়ারি হয় তখনো তিনি কমিটিকে জানান তিনি ইহুদীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের ধারণাটাকে সমর্থন করছেন না। কিন্তু ১৯৪৭ সালে সদ্যস্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে চিঠি লিখে ইহুদীদের রাষ্ট্র গঠনে সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি এও বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হয়ে মিত্রপক্ষ আরবদের ৯৯ শতাংশ ভূমি ফেরত দিয়ে ৫টি আলাদা রাষ্ট্র গঠণের সুযোগ করে দেয় এবং এক শতাংশ ভূমি রেখে দেয় ইহুদীদের তাদের আপন ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য।

১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন ইসারায়েলকে স্বীকৃতি দিলেন তখন আইনস্টাইন বলছেন, ‘দ্য ফুলফিলমেন্ট অব আওয়ার জিউস ড্রিমস’। আইনস্টাইন হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির একজন সদস্য ছিলেন এবং তাঁর যাবতীয় কাজকর্মের স্বত্ত্ব হিব্রু ইউনিভার্সিটিকে দিয়ে যান। তাঁর মূল কাজগুলোও হিব্রু ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন সেন্টারে সংরক্ষিত আছে।

আরও পড়ুন: আপনি মোবাইল ব্যবহার করছেন নাকি মোবাইল আপনাকে?

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর পর প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন চেম ওয়েজমান। ইসরায়েলের জায়োনিস্ট দলের সক্রিয় কর্মী হলেও, পেশাগত দিক থেকে একজন বায়োকেমিস্ট ছিলেন ওয়েজমান। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকার কারণেই আইনস্টাইনের অন্যতম অনুরাগী ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে আইনস্টাইনের অবস্থান এবং ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় আইনস্টাইনের অবদানের কারণেও কারণে তাঁর বাড়তি শ্রদ্ধা ছিলই। ১৯৪৯ সালে একটি বক্তৃতায় ওয়েজমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইহুদি ব্যক্তিত্ব হিসাবে উল্লেখ করেন আইনস্টাইনকে। যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল ইসরায়েলে। ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মারা যান চেম ওয়েজমান। এর সপ্তাহ খানেক পরে আইনস্টাইনের কাছে ইসরায়েল দূতাবাস থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। সেই চিঠি মূলত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের দায়ভার গ্রহণের অনুরোধপত্র।

আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট করার এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন। ওয়েজমানের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। তবে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও যে তাঁর বিজ্ঞানচর্চায় কোনোরকম অসুবিধা হবে না সেই আশ্বাসও দিয়েছিলেন ডেভিড। রাজি ছিলেন আইনস্টাইনের গবেষণার সমস্ত খরচার ভারবহনেও।

শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আইনস্টাইন। চিঠির জবাবে তিনি লেখেন, ‘এই প্রস্তাব পেয়ে আমি আগেবাপ্লুত কিন্তু একই সাথে আমি দুঃখিত এবং লজ্জিত যে আমি এটা গ্রহণ করতে পারছি না।’ সবিনয়ে তিনি জানান, তাঁর বার্ধক্য, অনভিজ্ঞতা এবং অপর্যাপ্ত দক্ষতা ইসরায়েলকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি রাজনীতির থেকে সমীকরণেই যে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাও জানান আইনস্টাইন।

তবে প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পরে ইসরায়েলে আরো লিজেন্ডারি হয়ে ওঠেন আইনস্টাইন। ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর ইসরায়েলে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি করা হয় আইনস্টাইন স্কয়ার। শুধু আইনস্টাইন স্কয়ারই নয়। সব মিলিয়ে আইনস্টাইনের মোট চারটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে ইসরায়েলজুড়ে। এমনকি ১৯৬৮ সালে আইনস্টাইনের ছবিও ছাপা হয় ইসরায়েলের নোটে। এই জায়নবাদী দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয় আলবার্ট আইনস্টাইনকে।

আইনস্টাইনকে অনেক মুসলিম স্কলার জায়নবাদী ছিলেন না বলে দাবি করে থাকেন। সত্যি হচ্ছে, তিনি কেবল জায়নবাদীই ছিলেন না বরং তিনি তাঁর কাজিনকে উরুগুয়েতে চিঠি লিখেছিলেন, ইসরায়েলকে সমর্থন করে এবং সে চিঠি নিলামে বিক্রি করে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পাঠানো হয়েছিল হাগানায় ইসরায়েলের সামরিক দপ্তরে অস্ত্র কেনার জন্য।

তবে হিটলারপূর্ব রাজনৈতিক দর্শনে শান্তিবাদী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তিনি একটু বুঝেশুনে পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সবসময়ই চেয়েছিলেন আরব এবং ইহুদিদের সহাবস্থানপূর্ণ বসবাস। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান ছিল অনেকটা পরাশক্তিগুলো বানিয়ে দিলে দিতে পারে, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না জোরজবরদস্তি করে টিকে থাকা সম্ভব। কিন্তু পরবর্তী প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন বরং তিনি তাকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিলেন।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও উদ্যোক্তা


সর্বশেষ সংবাদ