শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি: একটি যুগান্তকারী রায়

লেখক
লেখক  © টিডিসি ফটো

শিশু বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল অনেক আগে থেকেই। ভিন্ন ভিন্ন আইন ব্যাখ্যা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বয়স প্রদান করে ,যা বিচারিক অঙ্গনে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করে। সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে ২০১৩ সালের ২০, জুন “দ্য চিল্ড্রেন অ্যাক্ট ২০১৩” নামীয় একটি আইন প্রনয়ন করা হয়। উক্ত আইনটি ২০১৩ সালের ২৪নং আইন। উক্ত আইনে ধারা-৪ এর মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয় যে, ১৮ বছর, বয়সের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হবে।

এই সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করার পরেও শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ, আদালতের জুরিসডিকশন ও শাস্তি প্রদানের সময়সীমা নিয়ে ছিল অনেক কন্টোভার্সি। এতে করে আইন প্রণয়নের উদ্দ্যেশ্য ব্যাহত হচ্ছিল।

১২ ডিসেম্বর ২০২০ সালে দ্য ডেইলি স্টার এ নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় শিশু জিসান হত্যাকে কেন্দ্র করে আদালত ফৌজদারী কার্যবিধি- এর ধারা ১৬৪ মতে ১২ বছর বয়সী আরেক শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন ও শিশুটিকে সংশোধনাগারে প্রেরণ করা নিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়।

তাছাড়া ৬ বছর বয়সের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ভিকটিমের বাবা অপর ৪ জন শিশুকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসলে বিজ্ঞ উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ তাৎক্ষণিক গ্রেফতারকৃত চার শিশুর জামিনের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বরিশালের শিশু আদালতকে নির্দেশ প্রদান করেন। পাশাপাশি শিশুদেরকে রাতের মধ্যেই তাদের অভিভাভকের কাছে পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। আইন অনুযায়ী মামলা না নেওয়া, সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারক এখতিয়ার বহির্ভূত আদেশ দেয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেন বিজ্ঞ আদালত।

এইভাবে শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ ও এর সাক্ষ্যমূল্য, তাছাড়া কোন আদালত শিশুর শাস্তি প্রদানে কম্পিটেন্ট এবং কত বছর পর্যন্ত শিশুদের শাস্তি প্রদান করা যায় এই নিয়ে তৈরি হয় অনেক বিশৃঙ্খলা ।

এই সকল সমস্যা ও বিভ্রান্তি দূরীকরণের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট “মোঃ আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র”(ক্রিমিনাল আপীল নং -৬৭৯৯) মামলায় হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ রায় দেন যে, শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আইনগত কোন সাক্ষ্য মূল্য নেই। শিশুর দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা তাকে দোষী প্রমাণ করা যাবে না। আদালত আরো বলেন যে, শিশু বিচারের এখতিয়ার শুধুমাত্র শিশু আদালতের। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল (দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন,২০০২ দ্বারা গঠিত) কোনভাবে শিশু আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে না। অপরাধ যাই থাকুক, শিশুদের ক্ষেত্রে ১০ (দশ) বছরের বেশি কারাদন্ডাদেশ দেওয়া যাবে না।

“মোঃ আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র”  মামলাটি  ২০১১ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল নং-৪ দ্বারা বিচারকার্য সম্পাদন হয় এবং আপীলকারিকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০(দশ) বছরের কারাদন্ডাদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে মামলাটি ২০১১ সালে ক্রিমিনাল আপীল নংঃ৬৭৯৯ দ্বারা হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করা হয়।   

হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চটি, ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ধারা-১৬৪ অনুসারে কোন শিশুর স্বীকারোক্তিমুলক জবানন্দি গ্রহণ ও চিল্ড্রেন অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠিত জুভিনাইল কোর্ট সম্পর্কে মামলার সাথে জড়িত আইনী ব্যাখ্যা প্রদানের লক্ষ্যে একটি পূর্ণ বেঞ্চ গঠন করতে মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানান। মাননীয় প্রধান বিচারপতি একটি আদেশ দ্বারা মামলাটির শুনানির জন্য ০২.১০.২০১৮ তারিখে  একটি পূর্ণ বেঞ্চ গঠন করেন। তাছাড়া কোর্ট জনাব,  খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং জনাব, এম আই ফারুকি সিনিয়র এডভোকেট এবং জনাব, শাহদিন মালিক এডভোকেট কে এই বিষয়ে কোর্টকে সহায়তা করতে এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ করেন। কোর্টের কাছে প্রশ্ন ছিল যে, ধারা-১৬৪ অনুযায়ী কোন শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের আইনি সম্পর্ক এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল (দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন,২০০২ দ্বারা গঠিত ) শিশু আদালতের এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে কিনা?

জনাব, খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, শিশুদের তাদের বাবা-মা, অভিভাবক বা রক্ষনাবেক্ষণকারীদের উপস্তিতিতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করার সময় অতিরিক্ত যত্ন ও সতর্কতা নেওয়া  উচিত।  কেননা, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সাক্ষ্যমূল্য নিখুঁত সত্যবাদিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার উপর  নির্ভর করে। তাছাড়া তিনি কিছু মামলার নজির উপস্থাপন করেন, জাইবার আলী বনাম স্টেট; ৬১ ডি এল আর ২০৮= ২৮ বি এল ডি ৬২৭; ব্লাস্ট (BLAST) বনাম স্টেট, ২২ বি এল ডি ২০৬।

জনাব, খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, ১৯৭৪ সালের আইন দ্বারা ক্ষমতা প্রাপ্ত কোর্টসমূহই কেবল জুবিনাইল (Juvenile) মামলা পরিচালনার ক্ষমতা রাখেন। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল (দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন,২০০২ দ্বারা গঠিত) কোনভাবেই  জুবিনাইল (Juvenile) কোর্টের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না,এমনকি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল (দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২ দ্বারা গঠিত) স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে জুবিনাইল (Juvenile) কোর্ট হিসেবে ধরে নিতে পারে না। এই প্রশ্নে তিনি কিছু মামলার নজির উপস্থাপন করেন, স্টেট বনাম মোঃ রউশান মন্ডল ইলিয়াস হাশেম, ৫৯ ডি এল আর ৭২=১৮ এম এল আর ( হাইকোর্ট ডিভিশন) ১৯৫; মোঃ রহমত উল্লাহ বনাম স্টেট , ৫৯ ডি এল আর ৫২০।

জনাব, খন্দকার মাহবুব হোসেন, শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল জুরিস্প্রুডেন্স অনুসরণ করা উচিত, অর্থাৎ অপরাধের ধরনের উপর ভিত্তি করে শাস্তি দেয়া উচিত। তাছাড়া , শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধির মানসিক অবস্থাও বিবেচনা করা উচিত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঘটনার দিন যে আইন কার্যকর ছিল, সে আইন অনুসারে শাস্তি দিতে হবে।

জনাব, এম আই ফারুকি, মামলার শুনানীকালে কিছু আইনর্জাতিক আইন ও মামলার রেফারেন্স দেন। পরিশেষে তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বনাম স্টেট, ২১ বি এল ডি (এ ডি) ৬৯ মামলাটি রেফার করেন ও বলেন যে, আন্তর্জাতিক আইন ও নজির অবজ্ঞা করা আমাদের আদালতের উচিত হবে না, এমনকি আদালত আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নীতি প্রণয়ন করা উচিত।

আদালত আইনজীবিদের যুক্তি তর্ক শুনার পর,মামলার বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষন তুলে ধরেন।

আদালত বলেন, ব্লাস্ট (BLAST) বনাম স্টেট, ২২ বি এল ডি ২০৬  মামলায় বলা হয় যে, একজন জুবিনাইল আপরাধীকে তার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তাকে দোষী প্রমাণিত করে শাস্তি প্রদান করেন।  হাইকোর্ট এই রিট পিটিশন দ্বারা উক্ত ট্রায়ালটি এখতিয়ারহীন হিসেবে ঘোষণা করেন। আদালত এর পেছনের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোন সাক্ষ্যমূল্য নেই। কেননা, জবরদস্তি, হুমকি ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়।

আদালত বলেন, ফৌজদারী কার্যবিধি - ১৯৯৮এর ধারা-১৬৪ ধারা-৩৬৪ এর সাথে পড়তে হবে এবং যাতে বলা হয়েছে অভিযুক্তের স্বীকারক্তি (confession of accused), কিন্তু একটি বারের জন্য শিশুদের স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দির কথা বলা হয়নি। শিশু আইনের ধরন অনুযায়ী এইটা গ্রহণ করা কষ্টসাধ্য যে ধারা-১৬৪ এর মাধ্যমে শিশুদের স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হবে ও পরবর্তীতে তা তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হবে।  

বিজ্ঞ ডেপুটি এটর্নি জেনারেল কতৃক রেফারকৃত মামলা মোঃ শুকুর আলী বনাম স্টেট, জেইল পিটিশন নং-৮ (২০০৪) এ কোথাও শিশুর স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সাক্ষ্যমূল্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি। তাছাড়া এই প্রশ্নটি উপস্থাপিত বা বিতর্কিত হয়নি।

সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, প্রাপ্ত বয়স্ক লোকদের তাদের স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। আমরা ২১ শে আগস্ট গ্রেনেট হামলায় গণহত্যা মামলার জ্বলন্ত উদাহরণ দিতে পারি যে, জজ মিয়া নামক একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দিতে বলা হয়। কিন্তু পরিবর্তিত প্রশাসনে সত্য উন্মোচিত হয়, তিনি অন্য এক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে সত্য উন্মোচিত করলেন, যা সম্পূর্ণভাবে পূর্বের স্বীকারোক্তির সাথে ভিন্ন ছিল। যখন প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দি, পুলিশ রিমান্ড, কাস্টডিয়াল নির্যাতন এর এই দৃশ্য তবে শিশুদের ক্ষেত্রে কি হবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায় যে তারা পুলিশ হেফাজতে কতটুকু সুরক্ষিত যদিও তাদের বাবা-মা উপস্থিত থাকছেন। তাই শিশুর দেয়া স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দি যা পরবর্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা হবে, আমরা তা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করছি।

এই ঘটনার আলোকে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হলো-

১) ধারা-১৬৪ আলোকে শিশুর দেয়া স্বীকারক্তিমূলক জবানবন্দির কোন সাক্ষ্যমূল্য নেই এমনকি পরবর্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে তার বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা যাবে না।

২) পূর্বে শিশু আইন-১৯৭৪ এবং বর্তমানে  শিশু আইন-২০১৩ দ্বারা গঠিত কোর্ট সমূহই কেবল এই সকল মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। বিচার ট্রাইব্যুনাল (দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন,২০০২ দ্বারা গঠিত) স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে জুবিনাইল (Juvenile) কোর্ট হিসেবে ধরে নিতে পারে না।

৩) যখন কোন শিশুকে মৃত্যুদন্ড বা যাবতজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত অপরাধের জন্য যখন কোন শিশুকে শাস্তি দেয়া হবে , সেক্ষেত্রে ১০ বছরের বেশি কারাদন্ডাদেশ দেওয়া যাবে না।

তাই পরিশেষে বলা যায়, শিশুদের বয়স নির্ধারণ ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত রায়টি একটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট  ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ