রাষ্ট্রের মালিকানার বিষয়টি আগে মালিকদেরই বুঝতে হবে
- মীর মোহাম্মদ জসিম
- প্রকাশ: ০৩ মে ২০২১, ০৪:৫৫ PM , আপডেট: ০৩ মে ২০২১, ০৪:৫৫ PM
রাষ্ট্র গঠনে ৪টি উপাদান দরকার হয়। নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার এবং যাকে কেন্দ্র করে এতো আয়োজন সে হলো জনগণ। তাইতো জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক বলা হয়। মালিকের সংখ্যা এতো বেশি সে কারণে নিজেদের বসবাসের ভূ-খন্ডটি সাজানো এবং সঠিক পরিচর্যার দরকার হয়। মালিকের কখন কি প্রয়োজন সেটি মিটানোর জন্য একটি কমিটি দরকার হয়। তাকে বলা হয় সরকার। তবে এ কমিটি একেক দেশে একেক রকম হয়ে থাকে। এটিও মোটা দাগে মালিকদের মানসিকতা এবং ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। সভ্য সমাজে এক রকম আবার অসভ্য সমাজে অন্যরকম।
আর এজন্যই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্রসহ নানান তন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে সারা পৃথিবীতে। তবে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই সমাদৃত রয়েছে সারা পৃথিবীতে। আর অন্য সব তন্ত্রের উদ্ধব হয় অতিমাত্রায় বৈষম্য এবং কিছু লোকের লোভ লালসা এবং আদিম প্রবৃত্তি থেকে।
মালিক যাতে নিজের মান সম্মান এবং স্বকীয়তা নিয়ে বসবাস করতে পারে সে জন্য দরকার হয় সার্বভৌমত্ব। এটা হলো মালিকদের ইজ্জত যা বিদেশী কোন রাষ্ট্রের মাধ্যমে যাতে নষ্ট না হয় সে দিকটি নিশ্চিত করে। কারণ ইজ্জত চলে গেলে সভ্যতার আর কিছুই বাকী থাকে না। আর তখনই রাষ্ট্র হুমকির মুখে পড়ে যায়।
এই মালিকরা যাতে ভূ-খন্ডের ভেতরে সম-অধিকার এবং সুশৃঙ্খলভাবে বসবাস করতে পারে সেজন্য সবার সম্মতিতে একটি সংবিধান বা কিছু বিধান তৈরি করা হয়। যা সবাই মেনে চলতে বাধ্য হন।
সংবিধানকে কেন্দ্র করে কিছু নিয়ম-কানুন তৈরি করা হয়। যেগুলো দিয়ে দুষ্ট এবং অসভ্য লোকদের দমানো সহজ হয় এবং সভ্যদের চলাচল মসৃন হয়।
নিয়মকানুন প্রয়োগ করার জন্য তৈরি হয় কিছু প্রতিষ্ঠান। নিয়োগ করা হয় জনগণের কিছু সেবক তথা সরকারী কর্মচারি। এরা তাদের নিজ নিজ সেক্টরে সেবকের মতো জনগণের প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে।
বিচার ব্যবস্থার দরকার হয় নাগরিকের স্বার্থেই। কোন নাগরিক যাতে অন্যায়ের শিকার হওয়ার পর সঠিক বিচার পান এবং অন্যায়কারী যাতে নিজেও অন্যায় কাজের বেশি শাস্তি না পান সেটি নিশ্চিত করা হয়। আরেকটি করা হয় সেটি হলো অন্যায়কারীকে জেলের মধ্যেই পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হয়। এবং এর মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর, উন্নত, সুশৃঙ্খল এবং শান্তিময় জনপদ তৈরি হয়।
এতো কিছুর পরেও কোন নাগরিক যাতে অন্যায় করে পার যেতে না পারে সেজন্য প্রত্যেকটি সমাজে এবং রাষ্ট্রে মিডিয়া বা গণমাধ্যম নামে একটি মাধ্যমের উদ্ভব হয়। এ মাধ্যমটি সমাজের সৎ, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য পন্ডিত ও জ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত হয়।
এ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা এতোটাই স্বচ্ছ হন যে জনগণ পত্রিকা বা টেলিভিশনে খবর দেখেই বিশ্বাস করে ফেলেন। মানে খবরটি হয় বস্তুনিষ্ঠ এবং নিরপেক্ষ।
তবে খারাপ লোকরাও কিন্তু বসে থাকে না। তারাও রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ইবলিশের মতো তাদের সন্তান পয়দা করে রাখে। ফলে রাষ্ট্রের মালিককে বুঝতে হবে কোনটা উপর শয়তানের আছোর আছে। ভালো মিডিয়া গ্রহণ আর খারাপগুলো বর্জন করতে হবে।
রাষ্ট্রের মালিক সংবিধান এবং আইনের বাইরে কিছু হচ্ছে কিনা তা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। তার চলাচল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে।
নজর রাখতে হবে কোন বিদেশ শকুনের নজর তার মালিকানাধীন ভূ-খণ্ডে পড়লো কিনা। কিংবা অভ্যন্তরীণ ইবলিশের বাচ্চারা বিদেশি শকুনদের সাথে আতাত করছে কিনা।
রাষ্ট্র তথা তার মালিকানাধীন ভূ-খণ্ডে যাদেরকে শাসনের ভার অর্পণ করেছে তারা সঠিক পথে আছে নাকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করছে তারও খবর রাখতে হবে।
মালিকের সেবা এবং মালিকের স্বার্থ বিঘ্ন হচ্ছে কি না সেটিও দেখতে হবে। যদি হয় তার সেবক সরকারকে বুঝাতে হবে। সঠিক পথে রাখতে হবে। এতে কাজ না হলে সেবক পরিবর্তন করতে হবে।
কারণ পৃথিবীতে সব মানুষই চায় তার জীবন ভালোভাবে চলুক এবং পরবর্তী জেনারেশন তথা তার ছেলে-মেয়ে সুন্দর একটি আবহাওয়ায় বেড়ে উঠুক। আর এজন্যই কেউ সৎ উপার্জনে এবং বেশিরভাগই অসৎ উপার্জনে তাদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে পড়াশুনা করান। এবং নিজেরা সেকেন্ড হোম বানান অন্য ভূ-খণ্ডে। দ্বিতীয় পক্ষটি নিজেরাও রাষ্ট্রের মালিক তবে শয়তানের এজেন্ট। এরা অন্য মালিকের সঙ্গে বেঈমানী করেন।
তবে রাষ্ট্রের মালিক কিন্তু জনগণের সেবক বনে যাওয়ারা এ দৌড়ে এগিয়ে থাকে বেশি। পিছিয়ে থাকে না যাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় তারাও।
রাষ্ট্রের এ মালিকরা যখন মত প্রকাশে ভয় পায়, পথে ঘাটে অপমান হয়, সেবকদের দ্বারা প্রহৃত হয় এবং সেবকদের অবহেলায় যেখানে সেখানে মরে থাকে তখন সে রাষ্ট্রের অবস্থা এবং মালিকদের অবস্থা অনুমেয়।
সর্বত্রই যখন ইবলিশের সন্তানরা নিয়ন্ত্রণে থাকেন তখন ১০ জনের স্পীড বোটে ২৫ জন উঠবে আর মারা যাবে। ৫০০ জনের লঞ্চে ২০০০ উঠবে আর মারা যাবে।
২৪ ঘন্টা গাড়ি চালানো ড্রাইভার দুর্ঘটনা ঘটাবে আর মারা যাবে। হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার সংকট থাকবে কিংবা গ্রামের হাসপাতালে ডাক্তার থাকবে না মারা যাবে। ন্যায় বিচারের অভাবে বিনা কারণে গুম-খুনের শিকার হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা না করে কিংবা নামকাওয়াস্তে পড়াশুনা করে সার্টিফিকেট নিয়ে জাতিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।
নৈতিকতা, মানবিকতা, আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় দারুণ। এর ক্ষত শত বছর বয়ে বেড়াতে হয়।
গণমাধ্যম যদি এসকল অনৈতিকতা, অবক্ষয় এবং সকল অন্যায়ের খবর মুক্তভাবে, নির্ভয়ে এবং কোন প্রকার বাধা ছাড়াই প্রকাশ করতে পারবে তাহলেই গণমাধ্যমকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত বলা যাবে।
কোন রাষ্ট্রের মালিকরা যখন এসব অবক্ষয় দেখেও না দেখার ভান করবেন, কোন প্রতিবাদ করবেন না এবং সর্বোপরি কোন প্রতিকারের ব্যবস্থাও করবেন না তখনই সে রাষ্ট্রে মালিক মালিকানা হারাতে বসবে। আর কোনভাবে ঝুলে থাকলেও ব্যক্তিত্ত্বহীন, মর্যাদাহীন ভাবেই থাকতে হবে।
নিশ্চয়ই মালিকরা এসব বুঝেন তবে কোন কারণে কিংবা দেশপ্রেমী নেতৃত্বের অভাবে তারা অসহায় হয়ে পড়লে ভুগতে তো হবেই।
তবে প্রকৃত মালিকদের দায়িত্ব মালিকদেরই নিতে হবে। তাদের অনুধাবন এবং ধারণ করতে হবে যে তারা রাষ্ট্রের মালিক। এ অন্য কেউ তার দায়িত্ব নিতে আসবে না। প্রকৃত মালিক হলেন তারা যারা সেবকের দায়িত্ব নেন নি।
সকল রাষ্ট্রের মালিকরা তাদের মর্যাদা নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করুক এটাই কাম্য হওয়া উচিত।
লেখক: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, দ্য বিজনেস স্যান্ডার্ড ও সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি