ভিসির ওপরই নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন এবং এগিয়ে যাওয়া

ড. মু. আলী আসগর
ড. মু. আলী আসগর  © টিডিসি ফটো

দেশের ৫০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চারটি অর্থাৎ ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, যেটি পরে আইন হয়েছে, সে আইনে চলে। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে ভোটাভুটির মাধ্যমে উপাচার্য হিসেবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করলে চ্যান্সেলর হিসেবে রাষ্ট্রপতি সেই তালিকা থেকে একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ সিনেটে ভোটাভুটির আয়োজন করেন নাই, ফলে কোনটিতেই এখন এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত উপাচার্য নেই। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলাদা আলাদা আইন আছে। তবে সে আইন অনুযায়ী ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়া নেই। রাষ্ট্রপতি উপাচার্য নিয়োগ করে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া, তাঁদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা এবং অযোগ্যদের নিয়োগ—এসব বিষয়ে গত কয়েক বছরে  অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, প্রায় সব সংকটের কেন্দ্রে আছেন উপাচার্যরা।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক উপাচার্য মু. ওয়াহিদ-উজ-জামান দুর্নীতির টাকা হজম করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দিয়েছিলেন। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতির হাত ধরে হাজী দানেশ থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মোশাররফ’। অধ্যাপক মোশাররফ হোসাইন মিঞাকে পরে অপসারণও করা হয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হককেও বিদায় নিতে হয়েছে। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে অপসারণ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তদন্ত কমিটি। উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। 

স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈতিক স্খলনসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের বিরুদ্ধে আরও যে অভিযোগগুলো উঠেছে সেগুলোরও প্রমাণ মিলেছে। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাসিরউদ্দিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে উপাচার্য পদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করেছেন তিনি। ২০১৫ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ২০১৭ সালে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে দেন রাবি উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। এর মাধ্যমে কম যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এ রকমভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাদের আগের শিক্ষক নিয়োগ  নীতিমালা অনুযায়ী যাঁদের আবেদনের যোগ্যতা ছিল না।

এছাড়া রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য এবং উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান কর্তৃক রাষ্ট্রপতিকে ধোঁকা দেওয়া ও এডহক ও মাস্টাররোলে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, উপাচার্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে বিভিন্ন বিভাগের সভাপতি নিয়োগ ইত্যাদি।

উন্মুক্ত শুনানিসহ বিভিন্নভাবে তদন্ত কাজটি করেন ইউজিসির দুই সদস্য। তবে রাবি উপাচার্য উন্মুক্ত শুনানিতে হাজির হননি, বরং গত ৯ সেপ্টেম্বর  ইউজিসি চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে রাবি উপাচার্য বলেন, “আমি ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে কর্তৃত্ববিহীন তদন্ত কমিটির তদন্ত বন্ধ করতে অনুরোধ করেছি। কারণ ইউজিসির তদন্ত কমিটি গঠন করার এখতিয়ারই নাই। কমিটি গঠনে কমিশনের যে অ্যাক্ট সেই অ্যাক্টে এই ক্ষমতা নাই। তাছাড়া তদন্ত কমিটি গঠন করতে হলে উপাচার্যের মর্যাদার একধাপ উপরের পদমর্যাদার সদস্যদের দিয়ে করতে হবে। যেহেতু ইউজিসির গঠিত তদন্ত কমিটিতে এর ব্যত্যয় ঘটেছে, সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।”

ইউজিসি সূত্র বলেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। দুই সদস্যের ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউজিসি চেয়ারম্যান কমিটি করে দিয়েছেন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কাজ করা হচ্ছে। পক্ষপাতমূলক কোনো কাজ কমিটির কোনো সদস্যই করেননি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করছি।

বিভিন্ন অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমের বক্তব্যে জানা গেছে, “শিক্ষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে দালিলিক প্রমাণসহ বক্তব্য চাওয়া হয়। পরে উপাচার্য একটি চিঠিতে উন্মুক্ত শুনানির জন্য কমিটিকে অনুরোধ করেন। পরে জুম অ্যাপের মাধ্যমে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে উন্মুক্ত শুনানির বিষয়ে তিনি রাজি হননি। তিনি বাদী-বিবাদীর উপস্থিতিতে উন্মুক্ত শুনানি করার জন্য অনুরোধ জানান। উন্মুক্ত শুনানিটাও তো তার অনুরোধেই করা হচ্ছে। এখানে উনি আবার ৭৩ অ্যাক্ট টেনে আনেন কিভাবে।”

ইউজিসি ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্য ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের ভিত্তিতে রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শুরু করা হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর (২৭ অক্টোবর ২০২০) অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় বলেন, ইউজিসি ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী ইউজিসি সরকার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে যেকোনো কাজ করতে পারে। সুতরাং ইউজিসির তদন্ত করার এখতিয়ার সুস্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। তাই এটি নিয়ে বিতর্ক তোলার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের অনিয়ম নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ জন্য উপাচার্যকে দায়ী করে কমিটি বলেছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড উপাচার্যের মতো সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এ কারণে উপাচার্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছ কমিটি। তারা বলেছে উপাচার্যের নৈতিকতা বিবর্জিত এই ধরনের কর্মকাণ্ড জরুরি ভিত্তিতে বন্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার; যাতে প্রাচীন ও এতিহ্যবাহী এই উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও গবেষণার সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন সাধিত হয়।

ইউজিসি তদন্তের জন্য উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বক্তব্য নিয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূরীকরণ সহ শিক্ষা ও গবেষণার মান সুরক্ষার স্বার্থে ১০ ডিসেম্বর ও ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে কিছু নির্দেশনা দেন ও কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন।

অধিকিন্তু রাবির ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের ৩ জন শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে (রীট পিটিশন নং- ৮৯৮৬/২০১৯) উল্লেখ আছে, “সর্বোচ্চ বিদ্যালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সর্বোচ্চ উঁচু মানের হবেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরসহ সকল কার্যক্রমের পরিচালনাকারী উপাচার্য হবেন আরোও উঁচু মানের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জাতীয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্মানজনক পেশা। এ পেশার কোন ব্যক্তি আইন এবং আদালতের আদেশ ভঙ্গ করতে পারে এটা সাধারণ মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেই অকল্পনীয় কাজটি করলেন। তিনি প্রকৃত পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সকল শিক্ষককে অপমান করেছেন।”

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের মাত্র দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিং মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান কিউএস ১০ জুন ২০২০ তাদের ওয়েবসাইটে এই র‍্যাঙ্কিংয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ২১টি ও পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ৷ এশিয়া থেকে অন্যদের মধ্যে চীনের ৫১টি, জাপানের ৪১টি, মালয়েশিয়ার ২০টি, সৌদি আরবের ১০টি, ইরানের ৫টি, ইসরায়েলের ৬টি ও সিঙ্গাপুরের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ইউরোপ থেকে অন্যদের মধ্যে জার্মানির ৪৫টি, ইতালির ৩৬টি, ফ্রান্সের ২৮টি, নেদারল্যান্ডসের ১৩টি ও ফিনল্যান্ডের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এই তালিকায়৷ কিউএসের এই র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দশে পাঁচটিসহ মোট ১৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। উপাচার্যের ওপরই নির্ভর করে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন এবং এগিয়ে যাওয়া। এমন একজন উপাচার্য দেখতে চান প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, সেখানকার শিক্ষক–শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সেকারণে সততা ও নীতি-নৈতিকতা বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ প্রয়োজন।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ