ইউজিসিকে চ্যালেঞ্জ রাবি ভিসির ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় অবহেলা!
- ড. মু. আলী আসগর
- প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:৪৮ PM , আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:৪৮ PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা শিথিল করেছেন তিনি। এই পরিবর্তনের সুযোগে শিক্ষক হয়েছেন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এছাড়া উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে— রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ লঙ্ঘন করে বিভিন্ন বিভাগে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া, উপাচার্যের নির্দিষ্ট বাসায় ওঠার পরও আগের বাসা দীর্ঘদিন ধরে আঁকড়ে রেখে ভাড়া বাবদ আর্থিক ক্ষতিসাধন, স্বজনপ্রীতিসহ আরও বিভিন্ন অনিয়ম। এসব অভিযোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকেরা।
উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানসহ তাঁর প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত করেছে ইউজিসি (বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন) এবং তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে ২ মাস আগে জমা দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি তদন্তের জন্য উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বক্তব্য নিয়েছিল।
ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে গত ৯ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে (স্মারক নং উপা/২১) রাবি উপাচার্য এম আব্দুস সোবহান অভিযোগ তোলেন, “উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের কোনো ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে দেওয়া হয় নাই। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তে আপনার নির্দেশে ৩ (তিন) সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়েছে।” উক্ত চিঠিতে উপাচার্য আরোও উল্লেখ করেন, “এমতাবস্থায় উপরোল্লিখিত বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কর্তৃত্ববিহীন তদন্ত কমিটির সকল কার্যক্রম বন্ধ করার অনুরোধ করছি।”
ওই তারিখের চিঠিতে (স্মারক নং- উপা/২১) উপাচার্য আরোও উল্লেখ করেন, “আইন অনুযায়ী তদন্ত কমিটির সদস্যবৃন্দের মর্যাদা উপাচার্যের মর্যাদার এক ধাপ উপরে হওয়া বাঞ্ছনীয়।” তবে ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর উপাচার্যের পাঠানো চিঠিকে স্ববিরোধীতা বলে মনে করছেন রাবির শিক্ষকরা।
তারা বলছেন, উপাচার্য নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে জুনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে। উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানের অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী শিক্ষকদের একজন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী। তিনি এক গণমাধ্যমকে বলেন, “উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান আমার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন হেকেপের লাইব্রেরি উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে। তদন্ত কমিটিতে যারা ছিলো সবাই আমার জুনিয়র। অথচ এখন উপাচার্য নিজের বেলায় এসে পদমর্যাদার বিষয়টি সামনে আনছেন যা স্ববিরোধীতা।”
উপাচার্য তাঁর পছন্দনীয় শিক্ষকদের অপরাধের বিষয়ে সিন্ডিকেটে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেন না। কয়েকবার প্রমাণ সহ লিখিত অভিযোগ দেওয়া সত্তেও, উপাচার্যের পছন্দনীয় শিক্ষকদের পরীক্ষা কক্ষে দুর্নীতি, শিক্ষকদের লাঞ্জিত করা ও অসদাচারন, একাডেমিক কমিটির সভা পেশী শক্তি দিয়ে ভন্ডুল ইত্যাদির কোন তদন্ত কমিটি গঠিত হয় নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর উপাচার্যের পছন্দনীয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ বেশ কয়েকবার গ্রহণ করে নাই।
ইউজিসি সূত্র বলেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। দুই সদস্যের ইউজিসির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউজিসি চেয়ারম্যান কমিটি করে দিয়েছেন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কাজ করা হচ্ছে। পক্ষপাতমূলক কোনো কাজ কমিটির কোনো সদস্যই করেননি। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করছি। বিভিন্ন অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমের বক্তব্যে জানা গেছে, “শিক্ষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে দালিলিক প্রমাণসহ বক্তব্য চাওয়া হয়। পরে উপাচার্য একটি চিঠিতে উন্মুক্ত শুনানির জন্য কমিটিকে অনুরোধ করেন। পরে জুম অ্যাপের মাধ্যমে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে উন্মুক্ত শুনানির বিষয়ে তিনি রাজি হননি। তিনি বাদী-বিবাদীর উপস্থিতিতে উন্মুক্ত শুনানি করার জন্য অনুরোধ জানান। উন্মুক্ত শুনানিটাও তো তার অনুরোধেই করা হচ্ছে। এখানে উনি আবার ৭৩ অ্যাক্ট টেনে আনেন কিভাবে।”
ইউজিসি ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্য ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের ভিত্তিতে রাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শুরু করা হয়। অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর (২৭ অক্টোবর ২০২০) অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় বলেন, ইউজিসি ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী ইউজিসি সরকার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে যেকোনো কাজ করতে পারে। সুতরাং ইউজিসির তদন্ত করার এখতিয়ার সুস্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। তাই এটি নিয়ে বিতর্ক তোলার সুযোগ নেই।
ইউজিসি তদন্তের জন্য উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বক্তব্য নিয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূরীকরণ সহ শিক্ষা ও গবেষণার মান সুরক্ষার স্বার্থে ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে কিছু নির্দেশনা দেন ও কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন। উল্লেখযোগ্য নির্দেশনাগুলো হলো:
১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিতকরণ।
২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন।
৩) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কর্তৃক নিয়ম বহির্ভুতভাবে দখলে রাখা ডুপ্লেক্স বাড়ির ভাড়া ৫,৬১,৬০০/- (পাঁচ লক্ষ একষট্টি হাজার ছয়শত) টাকা সরকারী কোষাগারে জমা প্রদানপূর্বক চালানের কপি জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ।
৪) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর এম এ বারীকে অসদাচরণের জন্য রেজিস্ট্রার পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর্যুক্ত নির্দেশনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন উপাচার্যের অবশ্যই করণীয়। কিন্তু গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া দুটি বাসের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে আপাতত নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে কিনা এমন প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “না না, চিঠি আসলোই তো কালকে। এছাড়া রেজিস্ট্রারের অব্যাহতি বিষয়টি আইনি ব্যাপার।”
এ বক্তব্য বিভিন্ন অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে এবং উপাচার্য উক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন নাই। অধিকিন্তু, আমার জানা মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অদ্যাবধি কোন সিন্ডিকেট সভা ডাকা হয়নি।
এছাড়া গত ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নীতিমালা ২০১৫ শিথিল করে পরিবর্তিত নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান তার মেয়ে জনাব সানজানা সোবহানকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং জামাতা জনাব এ টি এম শাহেদ পারেভেজকে ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
উপাচার্যের এরূপ স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং গবেষণার মানও নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় উক্ত নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না, ১০ ডিসেম্বরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত পত্রে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়েছে।
গত ২৯ ডিসেম্বর বই উৎসব নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের দুনীর্তি-অনিয়মের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা যেসব অভিযোগ পেয়েছিলাম, সেগুলো ইউজিসির মাধ্যমে তদন্ত করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা সত্যতা পেয়েছি। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠিয়েছিলাম। আমরা এখন সেগুলো দেখব যে সেই নির্দেশনা তারা কতটা পালন করল বা করেনি। যদি না করে থাকে, তাহলে সেটি কেন করল না সে বিষয়ে আমাদের যা করনীয় সেগুলো নিশ্চয় আমরা করব।”
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়