আর কত বিশ্ববিদ্যালয় খুলবেন?

অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © টিডিসি ফটো

নারায়ণগঞ্জ, নাটোর ও মেহেরপুর জেলায় আরো তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। এই মর্মে আমাদের গুণধর ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টির স্থাপনা নির্মাণ লক্ষে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির বিষয় হলো "নারায়ণগঞ্জ, নাটোর ও মেহেরপুর জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নিমিত্তে আইন প্রণয়ন প্রসঙ্গে"! এতদিন দেখতাম সরকারি কর্মকর্তারাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে ডাকে। কিন্তু এখন দেখি স্বয়ং ইউজিসির চেয়ারম্যানও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করছেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি আসলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতো তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি কর্মকর্তা হতেন এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতেন। আদতে বিশ্ববিদ্যালয় হলো পাবলিকের পয়সায় চলা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান যেখানে শিক্ষক কর্মকর্তা কেউই পিএসসি কর্তৃক নিযুক্ত হয় না। Stop calling it "সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়" because they are not সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় rather they are "পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়"!

এইবার আসি আসল কথায়। আর কত বিশ্ববিদ্যালয় খুলবেন? প্রায় ৬০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে যদি দেশে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় হতো এবং বর্তমানে এই ৬০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে যেই বরাদ্দ দেওয়া হয় সেই একই পরিমান বরাদ্দ যদি ওই ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হতো তাহলে আমি নিশ্চিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানের চেয়ে ভালো মানের হতো। আমরা সংখ্যা দিয়ে মানুষকে আর কত বোকা বানানোর চেষ্টা করব? দেশে যদি একটিও ভারতের আইআইটি মানের বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো দেশটার চেহারা বদলে যেত। শত শত খারাপ জিনিসের বদলে একটি ভালো কিছু বানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৮৫টি বিভাগ ও ৫৬টি রিসার্চ সেন্টার আছে। এই বিভাগগুলোর অধিকাংশই খোলা হয়েছে গত ৩০ বছরে। এছাড়া গত ৩০ বছরে আরেকটি পরিবর্তন এসেছে সেটা হলো ৩+১ থেকে আমরা ৪+১ শিক্ষা ব্যবস্থায় গিয়েছি। এই দুইটির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা অসম্ভবভাবে বেড়েছে। এই বৃদ্ধির সাথে ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা, ক্লাসরুম ও শিক্ষকদের বসারঘরের ব্যবস্থা বৃদ্ধি পায়নি। পায়নি লাইব্রেরিতে অধিক ছাত্রের বসার ব্যবস্থা, জিমন্যাসিয়াম ও খেলাধুলার জায়গার ব্যবস্থা। তেমন বৃদ্ধি পায়নি বাজেট বরাদ্দ। যেইখানে বড়জোর ১৫ হাজার ছাত্রছাত্রী থাকার কথা সেখানে আছে প্রায় ৩৮ হাজার ছাত্রছাত্রী। এর ফলে ছাত্রদের আবাসিক সংকট চরমে। এত বড় বার্ডেনের সাথে আবার যোগ হয়েছে ৭ কলেজ। এইরকম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বৃদ্ধি কিভাবে আশা করেন?

এইসবের সাথে যদি সরকার শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে ক্যাম্পাসে পুতুল নাচ প্রদর্শন করে তাহলে এখানে পড়াশুনা করে ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে গ্লোবাল নাগরিক হবে? ফলে সরকার এমন একটি জেনারেশন তৈরী করছে যারা প্রশ্ন করতে জানেনা, জবাব চাইতে জানে না, প্রতিবাদ করতে জানেনা। ছাত্ররা করবে কি? শিক্ষকরাই করে না। এই যে টিএসসি ভেঙে নতুন বহুতল ভবন করার কথা বলা হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত কোথায় হচ্ছে। স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বলছে প্রাইম মিনিস্টারের নির্দেশে সরকারি নানা বিভাগ এর architectural ডিসাইন দেখভাল করছে।

অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্বায়ত্বশাসিত। এইসব করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের। আর টিএসসি ভেঙে কেন? কেউ কি এইটার দাবি করেছে? ভেঙে নতুন কিছু করতে চাইলে লাইব্রেরি জন্য বহুতল ভবন বানান, ছাত্রদের আবাসিক ভবন বানান। টিএসসির কলেবর বৃদ্ধি এখন প্রায়োরিটি না। আমাদের শিক্ষকদের মাঝে যারা সরকারি দল করে এইটুকুর প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনা। ভয় পায় প্রতিবাদ করলে যদি পদ পদবি বঞ্চিত হয়। এদের কাছে দেশ আগে না বরং দল এবং নিজে আগে।

এইসবই প্রমাণ করে কেন নলেজ ইনডেক্সের সূচক অনুসারে শিক্ষা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বাংলাদেশ পাকিস্তান নেপালের চেয়েও নিচে। শিক্ষা আমাদের কাছে রাজনীতির বিষয়। শিক্ষা আমাদের কাছে ব্যবসার বিষয়। শিক্ষা আমাদের কাছে পদ পদবীর বিষয়।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ