করোনায় বিপাকে নন-এমপিও শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনাভাইরাসের কারণে বিপাকে রয়েছেন নন-এমপিও শিক্ষক ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
করোনাভাইরাসের কারণে বিপাকে রয়েছেন নন-এমপিও শিক্ষক ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  © সংগৃহীত

করোনার কারণে চলতি বছরের মার্চ থেকে অদ্যাবধি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সময়মতো বেতন-বোনাস পেলেও নন-এমপিওভুক্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো রকম বেতন পাচ্ছেন না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো শতভাগ শিক্ষার্থীর বেতনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু যেহেতু স্কুল বন্ধ—তাই নেই কোনো কালেকশন, নেই কোনো বেতন। শুধু তা-ই নয়, স্কুলের ভবনভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল খরচ ইত্যাদি সমন্বয় করতে না পেরে অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন।

শহরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে এবং দেয়ালে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ফার্নিচারসহ স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন। পত্রিকায়ও ছাপা হচ্ছে ছোট ছোট বিজ্ঞাপন। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী। অন্যান্য পেশার লোকজন কাজ বা চাকরি হারিয়ে এখনো যাঁরা কোনো রকমে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁরা পুরনো পেশা বদলে নতুন পেশা বা ব্যবসা ধরেছেন। কিন্তু শিক্ষক বলে কথা—মানুষ গড়ার কারিগর, জাতির বিবেক এবং সবার শ্রদ্ধার পাত্র। যেকোনো পেশা কি বেছে নিতে পারেন? আর এটাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের এখন বড় সমস্যা।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নন-এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অনেককে। নামিদামি অনেক স্কুলের শিক্ষকরা কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে পেটের দায়ে কৃষিকাজ করছেন, ভ্যান চালাচ্ছেন, ইজি বাইক চালাচ্ছেন, ফল ও সবজি বিক্রি করছেন, ভেটেরিনারি ওষুধ বিক্রি করছেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষকদের এসব দুর্দশার আরো অনেক চিত্র প্রতিনিয়ত ফুটে উঠছে, যা কখনোই সভ্যসমাজের কাম্য নয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রম বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টিউশন ফি আয় থেকে প্রতিষ্ঠান ব্যয়নির্বাহের পর কর্মচারীদের খুবই সামান্য বেতন দেওয়া হয়। এসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু আয় করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু এখন সেটাও বন্ধ। সামর্থ্যবান কিছু স্কুলে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করা হলেও এখানে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এসব স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কারো পক্ষেই ল্যাপটপ কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব নয়।

এ ধরনের প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনের সাত লক্ষাধিক শিক্ষকের বেতন বন্ধ আছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার কোটি শিক্ষার্থী, ১৪ লাখ শিক্ষক এবং আট লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অবশ্য এবার করোনাকালে সরকার ৮০ হাজারের বেশি নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে প্রণোদনা দিলেও এই তালিকার বাইরেই রয়ে গেছে একটি বৃহৎ অংশ। তথ্যমতে, সারা দেশে তিন শতাধিক এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে প্রায় পাঁচ হাজার নন-এমপিও শিক্ষক রয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় আট থেকে ১০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীরও একই অবস্থা।

১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ছয় হাজার ১৬০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছিল। দীর্ঘ ৪০ বছর পর ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। কিন্তু বাদ পড়ে যায় চার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। করোনার দুর্যোগে চরম বিপদে আছেন এসব বিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী। রোজগারহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। দেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদেরও একই অবস্থা। চার হাজার ৩১২টি মাদরাসার ২১ হাজার শিক্ষক দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। অবশ্য করোনাকালে লক্ষাধিক নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। যেখানে একজন শিক্ষক এককালীন পাঁচ হাজার টাকা এবং কর্মচারী দুই হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছেন।

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের পেটে খিদে রেখে শ্রেণিকক্ষে ভালো পাঠদান সম্ভব নয়। তাই তাঁদের সংসারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসা উচিত। শিক্ষকদের এই দুর্দশা লাঘব ছাড়া গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বাগ্রে এই শিক্ষকদের দুর্দশা লাঘব করতে হবে। পাশাপাশি স্কুল মালিকদেরও দুর্যোগকালে কিভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যায় সে ব্যাপারে তহবিল গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের অনুমতি ছাড়া যত্রতত্র স্কুল খুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানো যাবে না।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: কালের কণ্ঠ


সর্বশেষ সংবাদ