বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া উচিত

  © সংগৃহীত

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলে যতই মুখভরা কথা আমরা বিভিন্ন মহলের কর্তাব্যক্তিদের বলতে শুনি আসলে বিষয়টি মন থেকে ক’জন বিশ্বাস করেন বা মেনে চলেন, তা বোঝার একটি উপযুক্ত সময় বোধকরি এসেছে। বিশেষ করে, করোনা মহামারি এই উপলব্ধি আমাদের মনে এত দিনে নিশ্চয়ই জাগাতে পেরেছে, আর যাই হোক শিক্ষা সেক্টরটি এদেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর নয়।

কেননা ৬ মাসের অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা-সমালোচনা কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো নয়। করোনার প্রাদুর্ভাব কমেছে নাকি বেড়েছে, এদেশে তা খুব একটি জানার উপায় আমাদের নেই। তবে একটা বিষয় আমরা সবাই জেনে গেছি, আমাদের সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণ করোনাকে খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না। কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ সাহস নিয়ে, কেউ সচেতনতার অভাবে যে যার মতো এটাকে মেনে নিয়েই পথ চলছে।

এবার আমাদের দেশের মতো নৈতিক সংকটময় একটি দেশের শাসক শ্রেণি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই দুর্নীতির শিকার। এখানে কোনো উদ্যোগই সুন্দরভাবে কারও পক্ষে বাস্তবায়ন করা সহজ হয় না। করোনা প্রতিরোধেও আমরা অনেকভাবেই ব্যর্থ হয়েছি। শুধু দান-খয়রাত ও ক্রয়ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে কোনো এক আগামীতে যদি প্রতিশেধক টিকার সন্ধান মেলে অথবা আল্লাহর অপার দয়ায় যদি এ ভাইরাস নিজে নিজে এদেশ থেকে চলে যায়, তাহলেই আমরা এ মহামারি থেকে পর্যাপ্তভাবে শঙ্কামুক্ত হতে পারব হয়তো।

আমরা জানি না, সেই শুভদিন কবে আসবে। আর এ কারণেই হয়তো দেরি না করে বাঁচি কিংবা মরি সব ধরনের ঝুঁকি নিয়েই ক্রমান্বয়ে এদেশের প্রায় সব ধরনের সেক্টর চালু হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানা; গণপরিবহন থেকে শুরু করে পর্যটন কেন্দ্রগুলো সবই অনেকটা আগের মতো বহাল তবিয়তে চলছে। হাটবাজার ও রেস্টুরেন্টে আগের মতোই ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছু মানুষকে শুধু মাস্ক পরা বা কিছুটা স্বাস্থ্য সচেতন বলে মনে হচ্ছে; এ পার্থক্য ছাড়া এদেশে কোথাও খুব বেশি চোখে পড়ার মতো তেমন পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। এককথায় দেশের কোনো কিছুই এখন আর থেমে নেই, সবই কম-বেশি চলছে।

তবে শুধু একটি জায়গায়ই শুধু ব্যতিক্রম। তা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। মেরুদণ্ড খুব একটি গুরুত্ব পাচ্ছে না যেন। এ অঙ্গটি ছাড়াও জাতি আজ চলতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। তবে মেরুদণ্ডের একটি অংশ সজীব রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা হল কওমি মাদ্রাসাসহ কিছু ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কর্তৃপক্ষ এদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে, এমনকি প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে, হোস্টেল বা বোর্ডিং চালু রেখে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে।

আগের মতো অর্থাৎ করোনা-পূর্বকালের মতো স্বাভাবিকভাবেই চলছে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো সংবাদমাধ্যমে এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাবজনিত কোনো বড় রকমের দুর্ভোগের সংবাদ আল্লাহর রহমতে পাওয়া যায়নি। তাহলে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কী হলো? তাদের সঙ্গে উল্লেখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈষম্য কোথায়? রাষ্ট্র বা সরকার যদি উল্লেখিত মাদ্রাসাছাত্রদের জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করেন তা দুঃখজনক।

তেমনটি মনে করার কোনো কারণ বর্তমানে এদেশে আছে বলেও মনে হয় না। আর যদি তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে সবাই নিঃসন্দেহে থাকেন, তাহলে বলতে হয়, অন্য শিক্ষার্থীদেরও কি এধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত না হয় শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বা স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতন নাও হতে পারে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেলায়ও কি এ ধরনের শঙ্কা থাকা সংগত?

আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যা যা গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা হচ্ছে (খুবই সংকীর্ণ ও অদূরদর্শী চিন্তায়) সেই সব সেক্টর অনেক ঝুঁকি নিয়েও চালু করা হয়েছে। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জীবন এভাবে আটকে গেলে তাদের, তাদের পরিবার এবং পরবর্তী সময়ে জাতির যে অনেক ক্ষতি হবে এ বিষয়টি আমরা ভাবছি না। নিরাপত্তার খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমনিতেই বিভিন্ন কারণে তাদের সেশনজট লেগে থাকে। আর এ ৬ মাসে তাদের জট যে কোন পর্যায়ে যাবে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো ভাবনাই আজ স্পষ্ট নয়, করোনা যেমন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছে যে, মানুষ কত একা কারও ভাবনা কেউ ভাবছে না। তেমনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও শিক্ষার্থীদের নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

অনলাইন ক্লাস চালু করা হয়েছে এতে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া এ কার্যক্রমে কেউ স্বাভাবিকভাবে সংগতি বিধান করতে পারছে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা আলাদা; সেখানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আর সরাসরি পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সূচিত হয় বলে মনে হয় না। করোনাকালে অনির্ধারিত বন্ধের ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে তেমন কোনো জটই সৃষ্টি হয়নি।

এবছরও তারা যথারীতি তিনটি সেমিস্টার পূর্ণ করতে যাচ্ছে। কেননা তাদের পরীক্ষা কার্যক্রমও অনলাইন প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকের পক্ষে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না; কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে শতভাগই সম্ভব হচ্ছে। এর কারণ আমাদের সবারই জানা।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুর্যোগ অবস্থায়ও ব্যাপকভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু পিছিয়ে আছে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অনলাইন ক্লাস চালু করতে এদের সময় লাগল প্রায় ৪ মাস। অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময় নষ্ট করেনি। অজুহাতের অভাব নেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে। নেগেটিভ ভাবনা থেকে যুক্তি খুঁজলে অজুহাতের অভাব হয় না।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের কথা, তাদের ক্যারিয়ারের কথা যদি একটু অনুভূতিপ্রবণ হয়ে চিন্তা করা যায়, তাহলে অনেকেরই হয়তো নজরে পড়বে এ মুহূর্তে কোনো কোনো অথবা প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাচ রয়েছে দুই থেকে তিনটি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা বা অন্তত ক্লাস সমাপ্তি হলে অনলাইনের মাধ্যমেই তাদের পরবর্তী সময় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দিতে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষকদের।

এই প্রক্রিয়ায় মাস্টার্স পর্যায়ের ব্যাচের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কিন্তু এ পর্বের শিক্ষার্থীদের কথা যদি ভাবা হয়, তাদের পরিবারের অবস্থা যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, অনেক পরিবারই এসব সন্তানের শিক্ষা সমাপ্তির দিকে চেয়ে আছে। পরিবারের হাল ধরতে হলে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করা জরুরি। তাই এই পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছে। অনলাইন ক্লাস হলেও তাদের পরীক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ করে, ফাইনাল পরীক্ষা এ ভার্চুয়াল সিস্টেমের মধ্যে আনা হচ্ছে না (যেমনটি হয়েছে এবং হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে)।

তাই তথাকথিত অনলাইন কার্যক্রম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিয়ন্ত্রণে এক লাইনও এগিয়ে দিচ্ছে না। এ কথাগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের বেলায়ই অনেকটা প্রযোজ্য। তবে বেশি প্রযোজ্য মাস্টার্স ও অনার্স ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। কেননা এ দুটি ইয়ার হলো- একেক পর্যায়ের ক্লোজিং ইয়ার। অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় পাসের ওপর অনেক চাকরির আবেদন করার যোগ্যতা নির্ভর করে। বিসিএস থেকে শুরু করে অনেক চাকরির ক্ষেত্রে এ দুই পর্যায়ের ডিগ্রি বিশেষ ভূমিকা রাখে।

তাই এ দুই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এই অবস্থায় এসে আটকে থাকা অত্যন্ত বেদনাবিধুর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের অবশ্যই উচিত এই পর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে কোনো উপায়ে হোক- তাদের ডিগ্রি সমাপ্ত করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য খোলা সম্ভব মনে না হলেও পর্যায়ক্রমে খোলা যায়। অবশ্যই অন্তত দুটো পর্বের : মাস্টার্স ও অনার্স ফাইনাল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এতে আবাসিক হলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষা করাও সম্ভব হবে। এসব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কার্যক্রমের জন্য হলেও অল্পদিনের জন্য তাদের হলে অবস্থান নিশ্চিত করা উচিত।

শিক্ষার্থীরা এই অধিকারের জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অনেকেই বাসা ভাড়া করে থাকা শুরু করছে এবং অনেকেই নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরব অঙ্গনে বিভিন্নভাবে জমায়েত হয়ে সরব করে তুলতে চাচ্ছে মৃতপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

করোনা অনেকদিন ভুগিয়েছে। আরও কতদিন ভোগাবে আমরা কেই জানি না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবনের গতি অনির্দিষ্টভাবে আটকে থাকতে পারে না। তাই পর্যায়ক্রমে হলেও, অর্থাৎ মাস্টার্সের সবগুলো ব্যাচ ও অনার্স চূড়ান্ত পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এদেশের সবচেয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। তাই স্বাস্থ্য নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত করা সংগত নয়। এতে রাষ্ট্র সাময়িকভাবে কোনো সমস্যায় না পড়লেও এসব শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনের ছন্দপতনের দায় কে নেবে? [লেখাটি আলোকিত বাংলাদেশে প্রকাশিত]

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ