ই-ভ্যালির লোভনীয় অফার, ক্রেতাদের লোভ, ভুল অর্ডার ও অভিযোগ

মোঃ আসাদুজ্জামান
মোঃ আসাদুজ্জামান

ই-ভ্যালি নিয়ে লিখছি, সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে ই-ভ্যালির ভারসাম্যহীন বিজনেস পলিসি নিয়ে। ই-ভ্যালি কীভাবে বিজনেস করে, বিজনেস পলিসি ঠিক নাকি ভুল সেটা নিয়েও ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ই-ভ্যালি থেকে যারা সরাসরি পণ্য কিনেছে তারা অধিকাংশই ই-ভ্যালিকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে। তবে চলমান তদন্ত কার্যক্রমকে সবাই স্বাগত জানাচ্ছে। অনেকেই ই-ভ্যালি থেকে পণ্য কিনে নিজেকে লাভবান মনে করছে, সবাইযে লাভে আছে এমনটা নয়, ভবিষ্যতে সবাই কেমন থাকবে সেটাই বড়। ধারণা করছি, এবারের তদন্তে ই-ভ্যালির কোনও ত্রুটির জন্য শাস্তি হলেও হতে পারে। কারণ, শুরু থেকেই তাদের বিজনেস পলিসি অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তাছাড়া একটি নতুন প্রতিষ্ঠান ছোটখাটো ভুল করতেই পারে।

এখন দেখবার বিষয়, ই-ভ্যালি অনৈতিক কিংবা অসাধু উপায়ের কারণে শাস্তি পেলে শাস্তিটা কতটুকু হয়, গ্রাহকদের ভোগান্তি কতটুকু হবে, ই-ভ্যালি তার বিজনেসে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে কিনা সেটাও গ্রাহকদের ভাবাচ্ছে। যদিও ই-ভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল তার ফেসবুক লাইভে (২৮ আগস্ট ২০২০, রাত ১১টা) বলেছেন, ই-ভ্যালির কার্যক্রম চলবে। সাময়িকভাবে ক্যাশ অন ডেলিভারি (COD) সিস্টেমে কেনা-বেচা চলবে (পণ্য হাতে পাবার পরে অর্থ পরিশোধ করতে হবে), এক্ষেত্রে কেউ চাইলে ইনভয়েসভেদে ই-ভ্যালির ব্যালেন্স থেকে ক্যাশব্যাকের ৩০% টাকা ব্যয় করতে পারবে। যেহেতু ব্যাংক একাউন্ট ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, ক্যাশ অন ডেলিভারি ছাড়া উপায়ও নেই। অবশ্য সিইও এই সিস্টেমকে সাময়িক সময়ের জন্য বলেছেন। তিনি অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে তার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ বৈধ বলে দাবি করেন।

ই-ভ্যালির কয়েকটি মারাত্মক ভুল যা নিজেদের ক্ষতির কারণ, একটি ভুল ছিল অফারের পণ্য একজনকে যতখুশি তত কিনতে দেয়া। এর ফলে একদল ব্যবসায়ী রিসেলার হিসেবে ই-ভ্যালিতে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পুরো মার্কেট প্লেসের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই ই-ভ্যালি বৈধ পথে থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রভাব খাটিয়ে বিজনেস পলিসি বের করতে চাইবে, বা মার্কেটে তারাও টিকে থাকতে চাইবে। বর্তমানে ই-ভ্যালি নিয়ে যত ঝামেলা হচ্ছে, সম্ভবত এটাই অন্যতম কারণ। ই-ভ্যালি এই ধাক্কা সামলাতে পারলে ভবিষ্যতে পূর্ণ আস্থা ফিরে পাবে, আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবে। সেই হিসেবে, সুষ্ঠু তদন্ত সবার জন্যই পজিটিভ বার্তা দিবে। ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে অবৈধ পলিসিতে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে, তাতেও তাদের প্রতারণা থেকে অন্ততপক্ষে কিছু গ্রাহক রক্ষা পাবে।

ই-ভ্যালি তার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে কেনাকাটার ক্ষেত্রে বারবার তাদের টার্মস এন্ড কন্ডিশন পরিবর্তন করেছে। এর জন্য নতুন গ্রাহকরা টার্মস এন্ড কন্ডিশন না বুঝেই হুটহাট অর্ডার করে ফেলছে। এর ফলে অর্ডার ক্যান্সেল হয়েছে, রিফান্ড প্রসেসের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তখনই বিভিন্ন গ্রুপে নেতিবাচক পোস্ট দেয়া শুরু হয়। যদিও এর বাইরেও ধীর গতির ডেলিভারিসহ কিছু যৌক্তিক অভিযোগতো আছেই।

ই-ভ্যালির নিজস্ব ফেসবুক গ্রুপ আছে। সেখানে তেমন কোন নেগেটিভ রিভিউ এপ্রুভ হয়না। কাস্টমার কেয়ারের অদক্ষতা ও নিজ গ্রুপে নেগেটিভ রিভিউ এপ্রুভ না হবার কারণে ঐসব গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে অন্যসব গ্রুপে তাদের সমস্যার কথা শেয়ার করে। এতেই ই-ভ্যালির ক্ষতিটা আরও বেশি হয়। বিভিন্ন সময়ে ই-ভ্যালির সিইও-কে অন্যসব গ্রুপে শেয়ারকৃত নেগেটিভ রিভিউয়ের কমেন্টে রিপ্লে করতে দেখা যায়, অনেকসময় সাথে সাথে ইস্যুর সমাধান করে দেন। অথচ নিজ গ্রুপে রেখেই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। তাহলে অন্যরা জানতে পারত না।

এবার বলি বিভিন্ন অফারে কিছু গ্রাহকদের ভুল কেনাকাটা ও লোভ নিয়ে- প্রতিটি সাইক্লোন, আর্থকোয়াক, থান্ডারস্ট্রোম অফারে ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশন থাকতো (কখনো ক্যাশব্যাক ব্যালেন্স, কখনো নগদ, কখনো উভয়, কখনো গিফট কার্ড, কখনো পার্সিয়াল পেমেন্ট সিস্টেমে পেমেন্ট করা ইত্যাদি)। প্রিমিয়াম ডিল, হট ডিল, মেগা ডিল, পোড অফার ইত্যাদির জন্যও ছিল আলাদা শর্ত।

পোড (POD-Payment On Delivery) অফারে ই-ভ্যালি ৭-১০ দিনের গ্যারান্টেড ডেলিভারিতে পণ্য সেল করে, অনেকসময় সাথে ক্যাশব্যাকও দিয়ে থাকে। গ্রাহকরা সেখান থেকে পণ্য কিনলে দেরিতে ডেলিভারির কোন প্রশ্ন তুলতে পারতো না। কিন্তু লোভ করে অন্য অফারের পণ্য কিনবে, যেখানে ১৫০% ক্যাশব্যাক দেয়, আবার ডেলিভারিও চাইবে ৭ দিনে, এটাতো ই-ভ্যালির পলিসিতে নাই। তারা অর্ডার নেয়ার সময়েই বলে দেয় ৭-৪৫ দিনে ডেলিভারি দিবে (৬০ দিনের বেশি হলে কখনো কখনো পণ্যের সাথে নির্দিষ্ট একটা পরিমান জরিমানাও দেয় গ্রাহককে)। রেগুলার শপে কেনাকাটায় ছিল ভিন্ন কন্ডিশন (৬০% ক্যাশব্যাক ব্যালেন্স এবং ৪০% নগদ), চাইলে শুধুমাত্র নগদ টাকায়ও কেনা যেত।

উল্লেখ্য যে, পোড অফারেও একটি আলাদা কন্ডিশন আছে, অর্ডার করে টাকা আনপেইড অবস্থায় রেখে দিতে হয়। ই-ভ্যালি ২/১ দিনের মধ্যে স্টক থাকা সাপেক্ষে ইনভয়েসে মেসেজ দিয়ে নগদ টাকা পে করতে বলে, অন্যথায় প্রোডাক্ট স্টকে না থাকলে অর্ডারটি(আনপেইড) ক্যান্সেল করে দেয়। কনফার্মড অর্ডারটি কাস্টমার টাকা পে করলে প্রোডাক্ট পেতে সর্বোচ্চ ৭-১০ দিন লাগে। কিন্তু এখানেও অনেক কাস্টমার ভুল করে ই-ভ্যালি থেকে কনফার্ম করার আগেই পেমেন্ট করে দেয়। ফলে অর্ডারটি(পেইড) শর্তভঙ্গের কারণে বা পণ্য স্টক আউট ইস্যুতে ক্যান্সেল হয়। বাতিল হওয়া অর্ডারটির টাকা ই-ভ্যালির ব্যালেন্সে যোগ হয়, পরে রিপোর্ট ইস্যু করে বিকাশ বা ব্যাংকে রিফান্ড পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ততক্ষণে ঐ গ্রাহক ই-ভ্যালির বদনাম সব গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ভুল করলো গ্রাহক, বদনাম হল ই-ভ্যালির।

আরো একটি জটিলতা আছে, কাস্টমার শর্ত না মেনে ভুল করে অর্ডারটি সাবমিট করে পেমেন্ট করে ফেললেও ৩ দিনে ক্যাশব্যাক পেয়ে যাবে। ঐ কাস্টমার হয়তো ক্যাশব্যাকের টাকা দিয়ে অর্ডার কনফার্ম হওয়া বা পণ্য ডেলিভারি পাবার আগেই গ্রোসারি পণ্য কিনে ক্যাশব্যাক খরচ করে ফেললো। এসব ভুলের কারণে যদি কাস্টমারের অর্ডার ক্যান্সেল হয়, তাহলে পুরো টাকা নগদ ক্যাশ দেয়া কি সম্ভব? সেতো ইতোমধ্যে যে টাকায় পণ্যের অর্ডার করেছে তার থেকে বেশি ক্যাশব্যাক পেয়ে খরচ করে ফেলেছে। এখানেই সমস্যাটি আরো বেড়ে যায়, তখন কাস্টমার অভিযোগ দেবার সময়ে কখনো বলেনা যে, তিনি ১০০ টাকা পণ্যের অর্ডারে ১৫০ টাকা ক্যাশব্যাক পেয়ে ঐ ক্যাশব্যাকের টাকা লোকাল এক্সপ্রেস সপ থেকে গ্রোসারি কিনে আগেই খেয়ে ফেলেছেন অথবা কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়েছেন। আবার ঐ ১০০ টাকাও রিফান্ড চাইছেন। এক্ষেত্রে ই-ভ্যালি কি তার জন্য ১৫০ টাকা লস দেবে?

ই-ভ্যালির এত এত অফার আর শর্ত নতুন কাস্টমারদের বিপাকে ফেলে। শর্ত না মানলেই অর্ডার ক্যান্সেল হয়, স্টক আউট সমস্যা, বিভিন্ন সেলার পেমেন্ট সমস্যাতো আছেই। রিফান্ড আবেদন ম্যানুয়ালি প্রসেস হতে সময় লাগে ডেলিভারি পাবার প্রায় সমান সময়, অর্থাৎ ৭-৪৫ দিন বা তার বেশি। কন্ডিশন মেনে অর্ডার পেমেন্ট করলে হয়তো পণ্যটি এতদিনে পেয়ে যেতো, তবুও রিফান্ড পাচ্ছেনা। ই-ভ্যালি চাইলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রিফান্ড ইস্যু অটোমেটেড করতে পারতো। সেক্ষেত্রে নিয়ম করতে পারতো, রিফান্ড নিলে সাথে সাথে ক্যাশব্যাক নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, পণ্য পাবার আগে বা অর্ডার কনফার্ম হবার আগে ক্যাশব্যাক ব্যবহার করা যাবে না। অবশ্যই স্টক ইস্যু ভেবে অফার দেয়া উচিত।

সবকিছু মিলিয়েই মনে করছি, বড় রকমের ক্যাশব্যাক অফার হচ্ছে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য ই-ভ্যালির পলিসিগত ফাঁদ। যেহেতু তাদের বিজনেস পলিসি জটিল, সেহেতু তারা চাইলে অফারের সব কন্ডিশন চিত্রায়িত করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে সহজ করে গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সেটা ই-ভ্যালি করে নাই। হয়তো ই-ভ্যালিও চেয়েছে কাস্টমাররা ভুল করুক, তাদের কাছে আটকে থাকুক। বাংলাদেশের লোকজন এখনো ডিজিটাল মাধ্যমে পিছিয়ে আছে, আর এই ডিজিটাল কেনাবেচায় লোভনীয় অফার প্রচার করে নতুন গ্রাহকদের জন্য এমন ফাঁদ পেতে বিজনেস করবে, এটা আমরা প্রত্যাশা করিনা। আমরা চাই ডিজিটাল প্লাটফর্মে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে সুরক্ষিত কেনাকাটা করতে।

সবশেষে, ই-ভ্যালি ও গ্রাহক উভয়েই বেঁচে থাকুক। এখনো দৃঢ়ভাবে আশা রাখতে চাই, অল্প ভুল ত্রুটি থাকলে ই-ভ্যালি শুদ্ধ হয়ে নতুনভাবে পথ চলুক, অভিযোগগুলো মিথ্যে প্রমাণিত হোক। সত্যিই ই-ভ্যালি দেশ সেরা ই-কমার্স হোক।

লেখক: প্রভাষক
মাটিভাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ
নাজিরপুর, পিরোজপুর।


সর্বশেষ সংবাদ